জাতীয় শিক্ষক দিবস: বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের হতাশার গল্প

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১২:৩৭ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৫, ২০২৩

সারোয়ার মিরন:
৫ অক্টোবর দেশে প্রথমবারের মতো সরকারি নির্দেশনায় পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষক দিবস ২০২৩খ্রি.। এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা ইতিমধ্যে জারি করেছে সরকার। স্বাধীনতার পর থেকে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে চলছে বেসরকারি তথা এমপিওভূক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। নানান সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হয়েও শিক্ষা সফলতার জিয়নকাঠি উঁচুতেই রেখে চলেছেন। শুধুমাত্র সরকার প্রদত্ত অনুদানের (বেতন-ভাতা) উপর ভরসা করে নয় সম্মান আর মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই একজন শিক্ষক জাতি গঠনে নিজেকে নিয়োজিত রাখছেন হাসি মুখে। তথাপিও এ দুর্মূল্যের বাজারে জীবন নির্বাহে সংকটময় সময় পার করছেন এমপিওভূক্ত শিক্ষকরা। জাতীয় শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বেসরকারি তথা এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের নানান সীমাবদ্ধতা ও বৈষম্যের কয়েকটা নিয়েই ধারাবাহিকভাবে লেখার চেষ্টা করছি। ভুলভ্রান্তির জন্য শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব।

শিক্ষার সকল স্তরে সরকারিবেসরকারি বৈষম্য:
মাধ্যমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চ -শিক্ষা স্তর পর্যন্ত বাংলাদেশে তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- প্রাইভেট, এমপিওভূক্ত এবং সরকারি। সাধারনত প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজেদের টাকায় পরিচালিত হয়। শিক্ষার্থীদের থেকে টিউশন ফিসহ বিভিন্ন নামে টাকায় আদায় করে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ব্যয় নির্বাহ করে। যদিও এ স্তরে একটি প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় নিবার্হ নিয়ে অনেক ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অন্যদিকে এমপিওভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয় সরকার কতৃর্ক নির্দেশিত নিয়ম-কানুনে। এ স্তরে নিয়োজিত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সরকার দিয়ে থাকে তবে প্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক-কর্মচারীগণ বেসরকারি। তিনধরনের শিক্ষাব্যবস্থার তৃতীয়টি হচ্ছে সরকারি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। কথা হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান গুলো সরকার থেকে কিছুই চাচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারি নিয়মে চলে। কিন্ত বেসরকারি বা এমপিওভূক্ত পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে নানান সীমাবদ্ধতা। এর কয়েকটা উদারহন তুলে ধরছি: সরকারি শিক্ষকরা বাড়ীভাড়া পান মূল বেতনের ৪০%-৪৫%, অন্যদিকে এমপিওভূক্তরা পান মাত্র ১হাজার টাকা; সরকারি শিক্ষকরা বোনাস পান মূল বেতনের পুরো অংশ, অন্যদিকে এমপিওভূক্তরা পান মাত্র ২৫%; সরকারি ব্যবস্থায় বদলির সুবিধা থাকলেও এমপিওভূক্তদের বেলায় সে ধরনের কোনই সুবিধা নেই।

বেতন-ভাতা খুবই নগণ্য:
স্নাতক-স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ একজন শিক্ষক বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর মাধ্যমে প্রিলিমিনারি, রিটেন, ভাইবা, পুলিশ ভ্যারিফিকেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতামূলক ধাপ পেরিয়ে তারপর হবু শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শুরুতেই বেতন পান ১২হাজার ৫শ টাকা। এর সাথে ভাতা হিসেবে বাড়িভাড়া ১হাজার এবং চিকিৎসা ভাতা ৫শ টাকা মাত্র। এখানেও বেশ কয়েকটি বৈষম্য রয়েছে। একজন হবু শিক্ষক বিএড ডিগ্রি ছাড়া যোগদান করলে বেতন পান ১২হাজার ৫শ টাকা। অন্যদিকে একই যোগ্যতা সম্পন্ন হয়েও শুধুমাত্র তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষি, বিপিএড, তথ্য ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে যোগদান করলে বিএড ছাড়াই মূল বেতন ধরা হয় ১৬হাজার টাকা। অথচ বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শুরুতে বেতন ধরা হয় মাত্র ১২হাজার ৫শ টাকা। এসব বিষয়ের শিক্ষকরা কোন একদিন বিএড সম্পন্ন করলেই তবে ১৬হাজার স্কেলে বেতন প্রাপ্য হবেন।

শিক্ষক নিয়োগে খাবি খাচ্ছে এনটিআরসিএ:
দেশের প্রায় ত্রিশ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক পদ শুন্য রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কতৃর্পক্ষ (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিয়োগে এ পর্যন্ত চারটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। প্রায় প্রতিটি নিয়োগেই তারা অস্বাভাবিক সময়ক্ষেপন করেছে। সর্বশেষ চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে শুন্যপদের সংখ্যা ৬০হাজারের কাছাকাছি হলেও নিয়োগ সুপারিশ করেছে মাত্র ২৭ হাজার। এখানেও সময় লেগেছে প্রায় দশ মাস! নিয়োগ সুপারিশের এ উনিশ মাসে আরো পদ শুণ্য হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার পদ। শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানটি মামলায় জর্জরিত। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একেকবার একেক নিয়ম-নীতি চাপিয়ে দেয়ায় নানান অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়ায় ভুক্তভোগী নিয়োগ প্রত্যাশীরা এসব মামলা করছেন।

প্রধান, সহপ্রধান ও কর্মচারী নিয়োগে কমিটির পোয়াবারো:
সহকারি শিক্ষক নিয়োগের পুর্নাঙ্গ দায়িত্ব এনটিআরসিএ পেলেও কোন এক অদৃশ্য কারনে প্রধান শিক্ষক, সহপ্রধান শিক্ষক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনির কর্মচারী নিয়োগ ক্ষমতা পরিচালনা কমিটির হাতে রয়ে গেছে। এ সুযোগে এসব পদসমূহে নিয়োগকালীন বড়ধরনের আর্থিক লেনদেন ও দুনীর্তির বিষয়টি জড়িয়ে গেছে। প্রধান শিক্ষক ও সহপ্রধান শিক্ষক নিয়োগে ৩-১০লক্ষ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয় বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। কমিটি কতৃর্ক এসব পদসমূহে নিয়োগ ক্ষমতা থাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং কমিটির পোয়াবারো অবস্থা। সাধারন শিক্ষক এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত এসব প্রসাশনিক পদসমূহের নিয়োগ ক্ষমতা এনটিআরসিএ কিংবা স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠানে অর্পন করা হলে দুর্নীতি এবং স্থানীয় দাপট থেকে মুক্তি মিলবে। এতে করেই এসব পদে যোগ্যরা নিযুক্ত হতে পারবে। কি এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় এসব পদ সমূহের নিয়োগ ক্ষমতা কমিটির উপর রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়।

পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পান না শিক্ষক-কর্মচারীগণ:
হবু শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়েই দায় সারছে কতৃর্পক্ষ। কোন ধরনের পেশাগত প্রশিক্ষন ছাড়াই সরাসরি পাঠদান কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছেন শিক্ষকরা। সাধারন বিষয়ের শিক্ষকের কথা বাদই দিলাম, বেশ কয়েকটি টেকনিক্যাল বিষয় রয়েছে যেসব বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে সরাসরি পাঠদান কার্যক্রমে যুক্ত করানো নাবিক ছাড়া জাহাজ ভাসানোর মত ব্যাপার। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্ব প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। নিত্য নতুন তথ্য ও তত্ত্ব যুক্ত হচ্ছে, যুক্ত হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম-পাঠ্যপস্তুক, গবেষনা ইত্যাদি বিষয়। এসব বিষয়ে একজন শিক্ষককে সব সময় আপডেট থাকতে হয় বা মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু দেশের প্রায় ছয় লক্ষাধিক শিক্ষকের দক্ষতা ও পেশাগত উন্নতির জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা কই! বগুড়ার নেকটার এবং ঢাকার নায়েম ছাড়া উল্লেখ করার মতো শিক্ষক প্রশিক্ষন কেন্দ্র নেই। স্থানীয়ভাবে যেসব প্রশিক্ষন হয়ে থাকে এসবে আবার বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষকের সমাবেশ থাকে না। স্থানীয় শিক্ষক বা লোকবলই এসব আঞ্চলিক প্রশিক্ষনে যুক্ত থাকে। অবাস্তব হলেও সত্য যে, নিয়োগের প্রায় অর্ধযুগ সময় পেরিয়ে গেলেও শিক্ষকরা কোন ধরনের প্রশিক্ষন পান না। আবার কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান প্রধান আছেন তার অধীনস্তদের প্রশিক্ষণ গ্রহনে নিরুৎসাহিত করেন। দমিয়ে রাখেন।

ইএফটিতে বেতন যেন সোনার হরিণ:
বেসরকারি এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা অনুদান হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁদের বেতন ভাতা হলে ফলাও করে মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বেতন-ভাতার সরকারি অনুদানের চেক ছাড়ের নোটিশ প্রদান করেন। এরপর বেতন-ভাতা আসে ব্যাংকে। সেখানেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সময়ক্ষেপন করে। তালবাহানা করে। বেতন-ভাতা হাতে পেতে পেতে সময় লেগে যায় অর্ধ মাসের মত সময়। বেসরকারি শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল তাঁদের বেতন ভাতা যেন অন্যান্য সরকারি চাকুরেদের মত ইএফটি প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়। বহু দেন-দরবার করার পর ২০২১সালে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ইএফটির মাধ্যমে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন মাউশি। সেসময় প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সব শিক্ষকের তথ্য অনলাইনে সংগ্রহ করা হয়। তিন বছর সময় পেরিয়ে গেলেও সেই ইএফটি’র খরব আর নেই। প্রক্রিয়াটি কোন পর্যায়ে রয়েছে সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানেন না সাধারন শিক্ষকরা।

চলবে….

 

লেখক: সারোয়ার মিরন

প্রকাশক ও সম্পাদক, দেশালোক ডটকম।