নির্বাচিত কলাম: নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১১:১২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২৪

 

আমানত উল্যাহ:

প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার, প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদা পালন করা মানবজীবনের একটি ভাল গুণ। চলার জীবনে কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষা, ওয়াদা পালন করা কঠিনতম সর্বোৎকৃষ্ট কাজও বটে। সমাজ জীবনে যারা এই গুণের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারাই মানুষের কাছে আদরনীয়, সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের চারপাশে নির্বাচনের নামে বিভিন্ন রুপে আবির্ভূত হন প্রার্থীরা। নির্বাচন আসলে এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য জনগনকে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কি কখনো বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? নাকি তারা তাদের আখের গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন এ প্রশ্নের উত্তর নেওয়ার মত কি কোন মানুষ এ সমাজে নেই?। সময় আসে, সময় চলে যায়। কিন্তু দেশের মালিক জনগণ কি এসব প্রশ্নের উত্তর চেয়েছেন প্রার্থীদের কাছ থেকে? অবশ্যই না।

আমাদের দেশে কারা সবচেয়ে বেশি কথা দেয় এবং সবচেয়ে কম কথা রাখে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কারণ, এ বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণাকর্ম চোখে পড়েনি। তবে আমাদের চারপাশের মানুষগুলোকে পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই চোখে পড়ে রাজনীতিকদের কথা দেওয়া এবং কথা না রাখার বিষয়টি। যদিও এর যথাযথ কারণও আছে।

আমাদের দেশের মানুষের চাহিদা ও দাবি-দাওয়ার কোনো শেষ নেই। কেবল দাও দাও। রাজনীতিবিদরা যখন সাধারণ মানুষের সমর্থন পেতে চান, তখন তাকে নানা প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। কারণ, রাজনীতিবিদদের কাছে সাধারণ মানুষ অনেক ধরনের দাবি-দাওয়া রয়েছে। প্রতিশ্রুতি বা কথা না দিয়ে রাজনীতিবিদদের কোনো উপায় থাকে না। তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হন। আর প্রতিশ্রুতি পালনের বাধ্যবাধকতা আমাদের দেশের রাজনীতিতে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জনগণের সামনে ভোট প্রার্থনা করতে গিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রার্থীরা। যা পারবেন তা তো দিচ্ছেন। যাহা পারবেননা তাও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভোটারদের মন পেতে তারা পারলে আকাশ থেকে চাঁদ-সূর্যকেও খুলে আনার প্রতিশ্রুতি দেন!

৫ বছর শেষে আবারও এলো নির্বাচন। এখন কি জনগন ওই প্রার্থীর কাছে জানতে চাচ্ছেন যে, আপনার আগের ওয়াদা রক্ষা করতে পেরেছেন? অবশ্যই পারেননি। তাই জনগনের উচিত এসব ওয়াপদা ভঙ্গকারি প্রার্থীদের বয়কট করা। যিনি বিগত ৫ বছর জনগণের সাথে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি, তিনি এ জনতার ভোট পাওয়ার অধিকারও রাখেননা।

আমাদের রাজনীতিকরা কারণে অকারণে প্রতিশ্রুতি দিতে থাকেন এবং ততোধিক কার্যকারিতার সঙ্গে এসব প্রতিশ্রুতি পরবর্তী সময়ে অবলীলায় অবজ্ঞা করতে থাকেন। এখন যেমন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিবেন, যা তাদের পক্ষে করা সম্ভব, তা যেমন বলছেন, তাদের পক্ষে যা করা সম্ভব নয়, তাও নির্দ্বিধায় বলছেন বা বলবেন।

নির্বাচনে প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, আইনগতভাবেই এগুলোর ৯৫ শতাংশ বাস্তবায়নের ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। এমপিদের থাকলেও উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র বা ইউপি চেয়ারম্যান যদি সত্যি সত্যি জনকল্যাণে অতি-উৎসাহী হন, একটু তড়িৎকর্মা হন, উচ্চতর মহলের খাস লোক হন, তাহলে বর্তমান ৫ শতাংশের বদলে বড়জোর আরও ১০-১৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পারবেন, এর বেশি নয়। এর বাইরে কোনো কিছু করার ক্ষমতা আসলেই তার নেই। কারণ এদের ক্ষমতা খুবই সীমিত। ভৌগোলিকভাবে তাকে ৫ বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকার প্রধান’ বলা হলেও আসলে তিনি অনেকটাই খর্ব ক্ষমতার। কারণ বর্তমান নির্বাচন ও জনপ্রতিনিধিরা সম্পুর্ন আমলা নির্ভর। তারা চাইলেই কিছু করা সম্ভব নয়।

নির্বাচন আসলেই হাটবাজার গরম হবে। প্রার্থীরা উদ্ভট প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হবেন। এই প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করা কতটা তাদের পক্ষে সম্ভব, কতটা নৈতিক বা কতটা আইনসম্মত হবে, তা নিয়ে অবশ্য কেউই মাথা ঘামাচ্ছেন না। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রত্যেক প্রার্থীরই দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। নির্বাচনী মাঠে মনে যা আসে তা বলে পেলা উচিত নয়।

নির্বাচন আসলে ভোটারদের উচিত। পূর্বের প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা সম্পর্কে তার কাছ থেকে উত্তর নেওয়া। জনতার সামনে জবাবদিহি করার মানুষিকতা সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিশ্রুতি পালনের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার। যাতে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে তাদের দেওয়া ওয়াদা পালনে অঙ্গিকারাবদ্ব থাকেন। উল্লেখ্য, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলের এক মেয়রকে তার কার্যালয় থেকে বের করে এনে একটি পিকআপ ট্রাকের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর এ কাজ করেছেন তারই এলাকার স্থানীয় কৃষকরা। মেয়র বলেছিলেন, রাস্তা ঠিক করে দেবেন। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও তা করেননি তিনি। ফলে ক্ষুব্ধ জনগণ মেয়রকে এই সাজা দেন। আমাদের দেশে ভোটাররা যদি সচেতন হতেন, যদি প্রতিশ্রুতি আদায়ে সোচ্চার হতেন, তাহলে কোনো প্রার্থীই বাহুল্য প্রতিশ্রুতি দিতেন না। প্রতিনিয়ত মাইকের আওয়াজ, পলিথিন মোড়ানো পোস্টারে দূষণমুক্ত সুন্দর নগরী গড়ে তোলার স্ববিরোধী প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ‘দুঃসাহস’ দেখাতে পারতেন না এসব প্রার্থীরা।

তাই জনগন ও ভোটারদের উচিত, টাকার কাছে বিবেককে বিক্রি না করে নিজ নিজ সমাজকে উন্নত করতে প্রার্থীদের এসব মিথ্যা ওয়াদার ব্যাপারে সচেতন থাকা। তাহলেই সমাজ ও দেশের উন্নতি হবে। নচেৎ নির্বাচন আসবে আর প্রার্থীরা ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে দিবেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবেনা। সামনে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচন আমাদের সন্নিকটে। নির্বাচনে জনগনের সমর্থন আদায়ে মিথ্যা ওয়াদা আর প্রতিশ্রুতি দিতে প্রার্থীরা একটু চিন্তাও করবেননা। তাই জনগনের উচিত ওই সব প্রার্থীদের প্রশ্ন করা, আগেরবার ভোট নিয়ে কি কি কাজ করছেন? আমাদেরকে দেওয়া কোন প্রতিশ্রুতিটি আপনি রক্ষা করছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জনতার সামনে নিতে পারলেই প্রার্থীরা তাদের দেওয়া ওয়াদা পালন করতে চেষ্টা করবেন।

লেখক:
সাধারণ সম্পাদক
রামগতি উপজেলা সাংবাদিক ইউনিটি ও
রামগতি-কমলনগর উপজেলা প্রতিবেদক
দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশ।