আরাফাত বিন আবু তাহের

শান্ত হও হে সর্বনাশা মেঘনা

নেইমপাম নেইমপাম

বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১০, ২০২০

আরাফাত বিন আবু তাহেরঃ কে করবে বিজয় কে বলবে উল্লাসে ‘তোরা সব জয়-ধ্বনি কর’!?
আসলে ব্যস্ততা দিন দিন এত পরিমাণে বাড়ছে যে ডানে বামে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছি না৷ প্রথম উপন্যাস, তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ আর ছোটদের রূপকথার গল্প- আপাতত এ তিনটা নতুন বইয়ের এডিটিং নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে সময় যাচ্ছে। কিন্তু যত ব্যস্তই হই না কেন দম ফেলতে হয়, নিশ্বাস টানতে হয়ই। এ সব ব্যস্ততার কারণে ইদানিং নেটে সময় দিচ্ছি কম। ফেসবুকে লগইনই করি দিনে সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন বার। সচরাচর যেটা দেখি না এ কয়দিনে সেটাই দেখছি কেবল। ফিডে স্ক্রল করলেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের নিউজ চলে আসছে।
এখন পূর্ণ বর্ষাকাল। জলরাশির ভরা যৌবন। স্বভাবতই নদীতে পানির উচ্চতা বেশি। কিন্তু কত বেশি হওয়া স্বাভাবিক?!
নদীর এ কূল ভাঙবে ওকূল গড়বে নিয়ম। কিন্তু কতটা ভাঙবে তারও তো একটা হিসাব থাকবে?

বিগত সব বছরের রেকর্ড ভেঙে উত্তরবঙ্গে বন্যা। তার চেয়েও খারাপ অবস্থা লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি কমলনগরের উপকূলে৷ বন্যা নদীভাঙন একসাথে থাবা মেরেছে মেঘনা পাড়ের জীবনে। মানুষ, গবাদি পশু, খেতের ফসল আবার(!)- খেতই গেছে নদীতে বিলীন হয়ে, বাড়িঘর সব ডুবছে। দেদারসে ভাঙছে বাড়ি, মানুষের কান্নার জল নদীতে মিশেই কি স্রোতটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে? হ্যাঁ দিচ্ছেই তো। ওই যে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা বাড়ির একটা গাছ ধরে ভেসে আসছে ষাট বছরের একজন বৃদ্ধ। মাথায় পুঁটুলি নিয়ে গলা ডুবিয়ে কোন কূল ধরছে উজান ঠ্যালে ওই মেয়েটি। মনের সুখে গান গাইতে থাকা মাঠের রাখালটির চোখে পানি কেন?
দেখতে দেখতে লাগোয়া ঘরের চাল ভেসে যায় প্রতিবেশীর, চিরচেনা পথ ঘাট তলিয়ে সমুদ্রে, নবোঢ়ার রঙের আতস ডুবছে অথই জলে।
হে অশান্ত ফেনিল জলরাশি, এবার একটু শান্ত হও। এবার ঠরো তুমি।

এ নদীদের আমার চেনা আছে। উত্তাল মেঘনার বক্ষে দুলে দুলেই তো আমার পারাপার। সে মেঘনার নিষ্ঠুরতা সর্বজন-বিদিত। তার তীরে বেঘোরে নেমে আসে তমাল অন্ধকার।
নীড়হারা বনী আদমের দল ছুটছে কোথায়? মাথা তাদের গুঁজবে কোন খুপড়ির তলে? জমিজমা বাড়িভিটাহারা- নদীভাঙা মানুষের দুঃখের যে সীমা থাকে না, দারিদ্র্যসীমা ছাড়িয়ে মাথা ঠ্যালে উঠে দাঁড়াতে যে পারে না তিন প্রজন্ম পর্যন্ত সেটার খবর তো কেউ রাখে না।

রুটি রুজির প্রয়োজনে অনেক দূরে পড়ে থেকেও আমার মন চলে যায় উপদ্রুত নদীর ধারে। দুঃখী আর সর্বহারা মানুষের গলায় গলা মিলিয়ে অবুঝের মত কেঁদে মরি।

হতাশায় ক্রোধে মাথা যায় নেমে, হৃদয় বেদনায় মুষড়ে গেলে আর লেখালেখিতে মন বসে না, চোখ দৌড়ে যতই দেখি সামনে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। তখন টেবিল ছেড়ে পান্ডুলিপি ছুঁড়ে ফেলে ইচ্ছে করে ছুটে যাই সে সব দূরন্ত উপদ্রুত অঞ্চলে, ভাগ নিই তাদের অবর্ণনীয় দুঃখের শোকের। সেটা করতে না পেরে; মানুষেরা যেখানে প্রাণে বাঁচতে দু’বেলা অন্নের সন্ধানে পাগলপারা, মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে হয়রান,- সেখানে ফুলবাবু সেজে নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে ভেতরে ভেতরে কবিপ্রাণ কুঁকড়ে মরছে সারাক্ষণ।
এর শেষ কোথায়? নদী শাসনের কতদূর বাকি, পর্যাপ্ত সাহায্য আসবে কবে?- কে জানে সেসব, কে করবে বুভুক্ষু নদীদের জয়?!
মাথা তুলে উল্লাসে কবে বলতে পারব ‘তোরা সব জয় ধ্বনি কর’?

লেখকঃ কবি, সাহিত্যিক এবং বিচারক

(লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেয়া)