পারিবারিক বিশৃঙ্খলা রোধে করনীয়

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৪:৫০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২২, ২০২১

এন.ইউ আরিফ: আজকের আলোচ্য বিষয়ে তিনটি প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনা করার প্রচেষ্টা করবো। আশাকরি লেখাটি পাঠক সমাদৃত হবে। তাহলে চলুন প্রশ্ন তিনটি আগে দেখি:

১. বাবা মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক খারাপের কারণ কি?

২. ভাই-ভাই সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারন কি?

৩. বর্তমানে অত্যধিক বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ কি?

মানবসমাজ গঠনের মৌলিক উপাদান হলো পরিবার। সুন্দর, সুশৃঙ্খল, শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা অতুলনীয়।

১/ উপহাস নয় বরং উৎসাহ চাই : পরিবারের পক্ষ থেকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা প্রতিটি মানুষকে তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হতে সাহায্য করে। তাই প্রতিটি ভাইবোন যদি একে অন্যের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ ভাব দেখায় তবে সেখানে শান্তির বারি বর্ষিত হয়। পক্ষান্তরে অবজ্ঞা প্রদর্শন মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে। তাই সন্তানদের কর্তব্য হচ্ছে, পরিবারে অসুস্থ, মেধাহীন, বোকা কিংবা সরল কোনো সদস্যও যদি থাকে তার মুখে হাসি ফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাওয়া। কোরআনের বাণী : ‘মোমিনরা কেউ যেন অপরকে উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোনো নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে।’ (আল-হুজুরাত : ১১)।

২/ ভাই ভাই সবসময় সম্পর্ক ভালো রাখতে চাই কিন্তু সম্পর্ক খারাপ হয় একমাত্র স্ত্রীদের জন্য। তাই স্ত্রীদের বুঝতে হবে ভাই ভাই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময় পার করে ভ্রাতৃপ্রেমী হয়ে সেখানে আমি কেন সম্পর্ক নষ্ট করবো !!! আমারও তো একদিন সন্তান আসবে আমি কি আমার সন্তানদের ভাই ভাই খারাপ সম্পর্ক চাই???

৩/ মিরাশ বণ্টনে ন্যায়পরায়ণ হই : মানুষের জীবন, জ্ঞান কিংবা সম্পদ কোনোটিই তার চিরস্থায়ী নয়। আর কোনোটি দ্বারা তাকে পৃথিবীতে পরিতৃপ্ত করাও সম্ভব নয়। তবুও ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীর সামান্য একটু সম্পদ গ্রাস করতে ভাই তার বোন কিংবা বোন তার ভাইয়ের সঙ্গে যে কোনো ধরনের আচরণ করতে দ্বিধা করে না। অথচ মৃত্যুর পর তার জন্য বিশাল পৃথিবীতে জায়গা মাত্র সাড়ে তিন হাত। বস্তুত ইসলাম মিরাশ বণ্টনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেন, একজন পুরুষের অংশ দুইজন নারীর অংশের সমান।’ (সুরা আন-নিসা : ১১)।

৪/ ধর্মীয় অনুশাসন মানা চাই : ধর্ম থেকে বিচ্যুতিই আজ আমাদের অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে এসেছে। রঙিন পৃথিবীর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ধর্মকে আজকাল আমরা আদিম যুগের বিষয় বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের শক্তি-সামর্থ্য আছে বলে কথা দ্বারা অন্যকে কষ্ট দিচ্ছি, সুযোগ হলে কোনো সদস্যের গায়ে হাত দিতেও কার্পণ্য করছি না। অথচ এতে পরিবারের শান্তি, সৌহার্দ্য বিনষ্ট হয় এবং অন্তরের ভেতরে ভালোবাসার প্রদীপটি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসে। হাদিসে রাসুল (সা.) এরূপ আচরণ করতে নিষেধ করেছেন। ‘মুসলিম তো তিনি যার হাত (প্রহার) ও মুখ (গিবত, মিথ্যা, কুচক্রান্ত) দ্বারা অপর মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি : ১/১০)।

৫/ ধর্ম বিরোধিতায় আনুগত্য নয় : পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানকে সঠিকভাবে শৈশবেই ধর্মীয় জ্ঞান শেখানো। এটি ইসলাম ধর্মের ফরজ বিধানও বটে। সঠিকভাবে ধর্ম শেখার পর শরিয়তবিরোধী কোনো কাজে সন্তান অংশগ্রহণ করবে না। যদি স্বয়ং পিতা-মাতা আদেশ করেন তবুও তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। কিন্তু শরিয়ত সম্পর্কিত পিতা-মাতার যে কোনো আদেশ সন্তানের মতের বিরুদ্ধে গেলেও তা পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলাই আল্লাহর নির্দেশ। প্রসিদ্ধ সাহাবি সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ইসলাম গ্রহণ করার পর তার মোশরেক মা পণ করে সন্তানকে বললেন : আল্লাহর কসম! যতক্ষণ না আমি মৃত্যুবরণ করব অথবা তুমি মুহাম্মদ (সা.) কে অস্বীকার করবে, ততক্ষণে আমি কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করব না। সা’দ (রা.) জবাবে বললেন : মা! জেনে রাখ, যদি তোমাকে একশত বার প্রাণ দেওয়া হয়, আর শতবারই তোমার দেহ থেকে প্রাণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবুও আমি আমার ধর্ম থেকে ফিরে আসব না। (মুসনাদে আহমাদ : ২/১৬১৫)। এর পরক্ষণেই তার সমর্থনে আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করেন : ‘আমি মানুষকে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। তবে যদি তারা তোমাকে আমার সঙ্গে এমন কিছু শরিক করার প্রচেষ্টা চালায় যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না।’ (আল-আনকাবুত : ৮)।

৬/ ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতার অনুশীলন চাই : মানব জীবনে সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় ধৈর্য ও ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করা দুটি মহৎ গুণ। আল্লাহ নিজে ধৈর্যশীল এবং আমাদেরও ধৈর্যশীল হতে নির্দেশ দিয়েছেন। ধৈর্যশীল ব্যক্তিই সর্বাবস্থায় বিজয়ী হন, যদিও সেটি সাধারণ চোখে দেখা কষ্টসাধ্য। বিজয়ী হবেই না কেন, আল্লাহ যে ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন! সুতরাং সন্তানদের কর্তব্য সহনশীলতা অনুশীলন করা। আর বিশৃঙ্খলার চেষ্টা আমাদের শক্তিকে দুর্বল করে দেয় আর দেয় লাঞ্ছনা। আল্লাহ বলেছেন : ‘আর তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর। নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না। যদি তা কর তাহলে সাহস হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের শক্তি চলে যাবে। আর ধৈর্য ধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা-আনফাল : ৪৬)। সেই সঙ্গে বয়সে ছোট হলেও পরিবারের যে কোনো ব্যক্তির মতামতকে শ্রদ্ধা করতে হবে। মানুষের সম্পর্কে না জেনে কল্পনাপ্রসূত গিবত চর্চায় মেতে না উঠে সহনশীল হতে পারলে বিজয় নিশানটি নিজের দিকেই ত্বরান্বিত হয়।

আমাদের সমাজের মানুষরা যদি আলোচ্য বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হন এবং বিষয়গুলো মহান রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে পরিবারে বাস্তবায়ন করেন তবেই আমাদের পরিবার ও সমাজে শান্তির সুবাতাস বইবে। মনে রাখবেন! আপনার প্রদর্শিত পথেই আপনার পরবর্তী প্রজন্ম হাঁটবে। তাই অনুজদের জন্য হলেও একটি সুন্দর ও মসৃণ পরিবারের স্বপ্ন দেখুন। কোনো অবজ্ঞা, দোষ তালাশ, অধিকার হরণ কিংবা ক্রোধান্বিত মনোভাব পরিহার করে আসুন আমরা একই বৃক্ষের ছায়াতলে এসে মৃত্যুর কথা সামনে রেখে ক্ষণিকের পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে উভয় জগতের ভালোবাসা বিনির্মাণে ঐক্যবদ্ধ হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।

লেখক : এন ইউ আরিফ (সামরিক বাহিনীতে কর্মরত)

বিএসএস, এমএসএস ( রাষ্ট্র বিজ্ঞান) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়