২৯ বছরের বেতন বঞ্চনার অবসান হোক বেসরকারি কলেজ অনার্স শিক্ষকদের Sarwar Sarwar Miran প্রকাশিত: ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০ শাহ মো: রকিবুল ইসলাম: দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রাম অঞ্চলের গরীব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ১৯৯৩ সাল হতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজ গুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয় । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বিগত বিএনপি সরকারের ভ্রান্ত জনবল কাঠামো নীতিমালা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরদর্শীতার কারণে যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই কোর্স চালু করা হয় তা বাস্তবায়ন না হয়ে এখন কলেজ গুলোতে ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে । এর মূল কারণ হলো অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের “জনবল কাঠামো/ সরকারি নীতিমালাতে ” অন্তর্ভুক্ত না করা । দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে শিক্ষকেরা বেতন বঞ্চনার শিকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শুধু মাত্র জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণে শিক্ষকেরা বছরের পর বছর ধরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে । সংশোনাধীন জনবল কাঠামো সংশোধন কমিটির প্রথম মিটিংয়ে সকল সদস্য বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সর্ব সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনীহা ও কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারণে বিষয়টি উপেক্ষিত হতে যাচ্ছে । বর্তমান করোনা মহামারীর তান্ডবে উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত শিক্ষকগণ জীবন জীবিকা আজ কঠিন সমীকরণে। উল্লেখ্য যে,১৯৯৫,২০১০,২০১৩ এবং ২০১৮ তে জনবল কাঠামো সংশোধন করা হলেও এসব শিক্ষকদের দাবি সমসময় উপেক্ষা করা হয়েছে। তারপরেও দীর্ঘ আটাশ বৎসর হলো শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বেতনে কিংবা বেতনহীন অবস্হায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাদান করে আসছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি বিধি মোতাবেক এই সকল শিক্ষক নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। বিধি মোতাবেক একজন শিক্ষকের নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় এবং নিয়োগ ও মৌখিক পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ও ডিজি মহোদয়ের প্রতিনিধির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা ও সরকারি নীতিমালা মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শতভাগ বেতন -ভাতা ও সুযোগ সুবিধা প্রদানের নির্দেশনা থাকলেও সারাদেশে মোট বেসরকারি কলেজের ৯০% কলেজ কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিতে চায় না। জানা গেছে,শিক্ষকদের বেতনের নাম করে গরীব ছাত্রছাত্রীদের নিকট হতে মাসে ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে বেতন নেওয়া হলেও শিক্ষকদের বেতন বাবদ ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে দিয়ে থাকে যা একজন শিক্ষকের বর্তমান বাজার দরে জীবন জীবিকা নির্বাহ করা অসম্ভব। শুধু তাই নয় অধিকাংশ কলেজেই মাসের পর মাস সামান্য টাকা টাও ফান্ডে অর্থ না থাকার অযুহাতে বন্ধ রাখা হয়। শুরুতে কলেজের সংখ্যা গুটি কয়েক হলেও ২০১৮ সাল পর্যন্ত তা ৫০০ ছাড়িয়ে যায় । ২০১৮ সালে বেসরকারি কলেজ গুলো জাতীয়করণ করার পর বতর্মানে অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানরত কলেজের সংখ্যা ৩১৫ টি । দীর্ঘ আটাশ বৎসরের বঞ্চনার এই দাবী আদায়ে শিক্ষকেরা বিভিন্ন সময় সভা, সমাবেশ, মানবন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করে। শিক্ষকদের এমপিও প্রদানের মূল সমস্যা জনবল কাঠামো হলেও দীর্ঘ আটাশ বৎসরে বঞ্চনার দাবির পক্ষে বেশ কিছু যৌক্তিক বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হলো : ১৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় কতৃক শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির বিষয়ে তিনটি নির্দেশনা (২০১৪\২০১৭\২০১৯) প্রদান করে । কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রনালয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে শিক্ষকদের বঞ্চিত করে রেখেছে । ২৷ দশম জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১২ ও ১৩ তম বৈঠকে শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত বিষয়ে দুটি সুপারিশ প্রদান করে । কিন্তু এই সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রনালয় বাস্তবায়ন না করে উচ্চশিক্ষা স্তরের এই শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত করে রেখেছে । ৩৷ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক দুজন মহাপরিচালক জনাব প্রফেসর ফাহিমা খাতুন/২০১৫ ও জনাব প্রফেসর এস এম ওয়াহিদুজামান/২০১৭ মহোদয়গণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনার আলোকে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিওভুক্তির জন্য সুপারিশ সহ আর্থিক খরচ কত হবে তা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে চিঠি দেন । কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রনালয় সেই চিঠি আজও আমলে না নিয়ে শিক্ষকদের বেতন বঞ্চিত করে রেখেছে । ৪। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয় ২০১৪ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয়কে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের শিক্ষকদের শিক্ষা নীতিমালাতে অন্তর্ভুক্ত ও এমপিওভুক্তির বিষয়ে মতামত চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় এখন পর্যন্ত উক্ত চিঠির কোন জবাব দেই নি । জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবহেলার কারণেও শিক্ষকেরা জনবল কাঠামো ও এমপিও বঞ্চিত হচ্ছে । ৫৷ একই সরকারি নিয়ম ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক বেসরকারি কলেজের অনার্স মাস্টার্স স্তরের নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের পূর্বের শিক্ষকেরা ক্যাডার মর্যাদা লাভ করেছে । এছাড়া সদ্য জাতীয়করণ কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা জাতীয়করণে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পেয়েছে নন ক্যাডার হতে চলেছে । অথচ বেসরকারি কলেজের অনার্স মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকেরা নূন্যতম এমপিওভুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে । যা সংবিধান পরিপন্থী । ৬৷ ১৯৯৩ সালের পরে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে সরকারি একক আদেশে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার জিবিজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সহ দেশের বেশ কয়েকটি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে জনবল কাঠামোতে অনার্স মাস্টার্স স্তর অন্তর্ভুক্ত না করায় অন্যান্য কলেজের অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকেরা যুগের পর যুগ ধরে বেতন বঞ্চিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে । ৭৷ বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের ন্যায় একই পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত জনবল কাঠামোর বাইরে থাকা ডিগ্রীর তৃতীয় শিক্ষকেরা ২০১০ সালের পূর্বে নিয়োগ প্রাপ্তরা এমপিওভুক্ত হতে পেরেছে এছাড়া ২০১০ সালের পরে নিয়োগকৃতদের এমপিও প্রদানের জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয় আর্থিক হিসাব প্রদান সহ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে । অথচ উচ্চশিক্ষা দানে নিয়োজিত অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের বারবার শিক্ষা মন্ত্রনালয় উপেক্ষিত করেছে। ৮৷ মাদ্রাসা পর্যায়ে বেসরকারি ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসার শিক্ষকদের জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে এমপিও প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে । অথচ একই সমমান পর্যায়ে শিক্ষা প্রদান করে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকেরা দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে জনবল কাঠামো ও এমপিও হতে বঞ্চিত রয়েছে । ৯৷ কলেজ কতৃপক্ষ কতৃক তথ্য অনুযায়ী বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স স্তরে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । কিন্তু সে সকল শিক্ষকেরাও বেতন বঞ্চিত । তাই মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার শিক্ষকতা পেশায় আসতে আকৃষ্ট করতে ও মান সম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও দেওয়া সময়ের দাবি । ১০৷ একই এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে যেখানে ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রী শিক্ষকেরা এমপিওভুক্ত হতে পারেন তাহলে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকেরা তাদের চেয়ে বেশী পরিশ্রম করে কেন এমপিও বঞ্চিত থাকবে ? ১১৷ সকলের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করণে সরকার যেখানে সকল স্তরে শিক্ষা ব্যবস্থা ফ্রি করে দেওয়া জন্য কাজ করছে সেখানে উচ্চশিক্ষা স্তরে বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের নিকট হতে অধিক হারে বেতন আদায় কতটা যৌক্তিক হচ্ছে? ১২৷ শিক্ষার্থীদের নিকট হইতে অধিক হারে বেতন আদায়ের পরেও শতভাগ বেতনের কথা উল্লেখ করে নিয়োগ দানের পরো শিক্ষকদের মাসে ২০০০-১০০০০ টাকা কলেজ ভেদে বেতন দেওয়া কতটা মানবিক ? ১৩৷ একই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যেখানে ডিগ্রী স্তরে ২১ বিষয় পাঠদানের জন্য শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে পারে ৩ জন । অন্যদিকে অনার্স স্তরে ৩০ টি বিষয় পাঠদান করেও একজন শিক্ষকও এমপিওভুক্ত হতে পারে না । যা সবচেয়ে অমানবিক বিষয়। ১৪৷ বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ৫০০-১৫০০ টাকা আর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ২৫ টাকা । এক দেশে দ্বৈত নীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন বৈষম্য থাকলে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করণ কিভাবে সম্ভব । ১৫৷ একই ছাত্র, বই, সিলেবাস, পরীক্ষা, খাতা দেখা ও একই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষক হয়ে কেউ সরকারি হবে আর কেউ নূন্যতম বেতন পাবেন না এটা হতে পারে না । বঞ্চনার এই কারণ সমূহ বিশ্লেষণ করে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বেসরকারি অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত অতীব জরুরী । এছাড়া চলমান করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষকেরা অত্যন্ত কষ্টে দিন অতিবাহিত করছে । তাই উচ্চ শিক্ষাদানে নিয়োজিত এই সকল শিক্ষকের হৃদয়ের বোবা কান্না উপলব্ধি করে তাদের কে অনতিবিলম্বে সংশোনাধীন জনবল কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে এমপিও প্রদান এখন সময়ের দাবি। আমাদের মমতাময়ী মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা উপমন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব সহ সরকারের নীতি নির্ধারকগণের নিকট আমাদের আকূল আবেদন বঞ্চনার এই দাবি দীর্ঘায়িত না করে অসহায় শিক্ষকদের কথা চিন্তা করে সংশোনাধীন জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে অতি দ্রুত এমপিও ঘোষণা দিবেন । লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান গোসাইবাড়ি অনার্স (ডিগ্রি) কলেজ, ধনুট, বগুড়া SHARES আইন আদালত বিষয়: