লালনের ১৩০তম তিরোধান দিবস আজ

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৫:০৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২০

আলম সাইফ ( .. সাইফুল আলম) : আজ ১৭ অক্টোবর বাউল সম্রাট মহাত্মা লালন শাহের (জন্ম ১৭৭৪- মৃত্যু অক্টোবর ১৭, ১৮৯০) ১৩০ তম তিরোধান দিবস। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি যিনি একটি অসাম্প্রদায়িক আধ্যাত্মিক জীবন দর্শনের শ্রষ্ঠা ছিলেন। লালন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী যিনি ধর্ম, বর্ন, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন।

অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গানসমূহ রচনা করেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুলের মত বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কন্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। .. লালন শাহ সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো:

জন্মঃ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া যায় লালন ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তবে বেশির ভাগ লালন গবেষক মনে করেন, লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মেছিলেন।

দীক্ষাঃ তরুন বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তার সাথীরা তাঁকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে যার যার গন্তব্যে চলে যান। কুমারখালির কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষু লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান তাঁকে বাড়িতে নিয়ে সেবা-শুশ্রষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এরপর লালন তাঁর কাছে দীক্ষিত হন এবং কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে স্ত্রী ও শিষ্যসহ বসবাস শুরু করেন। গুটিবসন্ত রোগে একটি চোখ হারান লালন।

ধর্ম বিশ্বাসঃ লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কুল, বর্ণ লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না।লালনের পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন,

‘‘কাঙাল হরিনাথ তাঁকে জানতেন, মীর মশাররফ চিনতেন, ঠাকুরদের হাউসবোটে যাতায়াত ছিল, লেখক জলধর সেন বা অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় তাঁকে সামনাসামনি দেখেছেন কতবার, গান শুনেছেন, তবু জানতে পারেননি লালনের জাতপরিচয়, বংশধারা বা ধর্ম।”

একটি গানে লালনের প্রশ্নঃ

‘‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।

যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান

জাতি গোত্র নাহি রবে।। ”

লালনের আখড়াঃ লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরি করেন, যেখানে তিনি তাঁর শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন।

ঠাকুর পরিবারের সাথে সম্পর্কঃ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেকের সঙ্গে লালনের পরিচয় ছিল । বিরাহিমপুর পরগনায় ঠাকুর পরিবারের জমিদারিতে ছিল তাঁর বসবাস এবং ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা ছিলেন তিনি। ঊনিশ শতকের শিক্ষিত সমাজে তাঁর প্রচার ও গ্রহণযোগ্যতার পেছনে ঠাকুর পরিবার বড় ভূমিকা রাখেন বলে জানা যায়।

লালনের ছবিঃ লালনের জীবদ্দশায় তাঁর একমাত্র স্কেচটি তৈরি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তাঁর বোটে বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

মৃত্যুঃ ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়াতে নিজ আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তার শিষ্যদের কে বলেনঃ “আমি চলিলাম’’ এবং এর কিছু সময় পরই তাঁর মৃত্যু হয়। লালনের নির্দেশ বা ইচ্ছা না থাকায় তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোন ধরনের ধর্মীয় রীতি নীতিই পালন করা হয়নি। তাঁরই উপদেশ অনুসারে ছেঁউড়িয়ায় তাঁর আখড়ার মধ্যে একটি ঘরের ভিতর তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

বিশ্ব সাহিত্যে প্রভাবঃ লালনের গান ও দর্শনের দ্বারা অনেক বিশ্বখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক প্রভাবিত হয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের মৃত্যুর ২ বছর পর তাঁর আখড়া বাড়িতে যান এবং লালনের দর্শনে প্রভাবিত হয়ে ১৫০টি গান রচনা করেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও রচনায় তিনি লালনের প্রসংগ তুলে ধরেছেন। লালনের মানবতাবাদী দর্শনে প্রভাবিত হয়েছেন সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আমেরিকান কবি এলেন গিন্সবার্গ লালনের দর্শনে প্রভাবিত হন এবং তাঁর রচনাবলীতেও লালনের রচনাশৈলীর অনুকরন দেখা যায়।

তিনি After Lalon নামে একটি কবিতাও রচনা করেন। লালনের মৃত্যু দিবসে ছেঁউড়িয়ার আখড়ায় স্মরণোৎসব হয়। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ লালন স্মরণোৎসবে ও দোল পূর্ণিমায় এই আধ্যাত্মিক সাধকের দর্শন অনুসরণ করতে প্রতি বছর এখানে আসেন। বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় ২০১০ সাল থেকে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী উৎসব হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানটি “লালন উৎসব” হিসেবে পরিচিত। দুঃখের বিষয় এবছর করোনা মহামারীর কারণে লালনোৎসব হচ্ছে না। তবে সংক্ষিতাকারে লালনের জীবনের উপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হবে।

লেখক: উপপরিচালক, সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচি, এসইডিপি

ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত