জাতীয় রাজনীতিতে রামগতির নেতৃত্বের সংকট কি আসন্ন!

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৮:৪৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ৪, ২০২১

সারোয়ার মিরনঃ

মরহুম জমীর আলী দিয়ে  জাতীয় পর্যায়ে রামগতির গুনী ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বের শুরু এবং মরহম শফিউল বারী বাবুতে এসে শেষ! হ্যাঁ, জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে রামগতির সংকটই বলা চলে! বর্তমান সময়ে আসম আবদুর রব থাকলেও বয়স এবং রোগে শোকে নিষ্প্রভ তিনি। লাইমলাইটে নেই আর কেউ! সামনের এক দু যুগে তরুনদের কেউ উঠে এসে জাতীয় রাজনীতিতে রামগতির নেতৃত্বের হাল ধরতে তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না৷ তবে কি জাতীয় রাজনীতিতে রামগতির অংশগ্রহন নিঃশেষ হতে চলেছে! জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয়া বেশ কয়েকজন গুনী ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য বর্ননার মাধ্যমে তেমনটাই তুলে ধরার চেষ্টা করবো আজকের এ লেখায়।

আলহাজ্ব মোঃ জমীর আলিঃ

১৯৪০ সালের ২৯ নভেম্বর রামগতি উপজেলার চরআলেকজান্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৫৯-৬০ সালে হন ঢাকা কলেজ এর জিএস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফোরামের সভাপতির সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৭০ সালে মুসলীম লীগে যোগদান করেন এবং পুর্ব পাকিস্তান মুসলিমলীগের সভাপতি ফজলুল কাদের এর রাজনৈতিক সচিব হন। ১৯৭৯ সালে মুসলীমলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৬ সালে মহাসচিব হন। ২০০৪ সালের ২৫ ডিসম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

আসম আবদুর রবঃ

১৯৪৫সালের ২জানুয়ারী রামগতি উপজেলার চর বাদামে জন্মগ্রহন করেন তিনি। স্বাধাীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলক, ঢাকসু’র প্রথম ভিপি এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তিনি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। বর্তমানে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি’র) সভাপতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ৭ম সংসদে ঐক্যমতের সরকারে তিনি নৌ পরিবহন মন্ত্রী এবং পরবর্তীতে পশু সম্পদ মন্ত্র হন। মুক্তিযুদ্ধের এ সংগঠক ১৯৭১ সালের ২মার্চ স্বাধীনতার প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন তিনি। বক্তৃতা বিবৃতির জন্য তিনি এশিয়ার যুব কন্ঠ নামেও পরিচিত।

আলহাজ সিরাজুল ইসলামঃ

সাবেক সাংসদ এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আলহাজ সিরাজুল ইসলাম ১৯৩৫ সালে কমলনগর (সাবেক রামগতি) উপজেলার চরনলরেঞ্চ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ১৯৭৩ সালে এ অঞ্চলের (রামগতি-হাতিয়া) সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭০ সালে সাধারন নির্বাচনে একই এলাকা থেকে জাতীয় গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং রামগতি আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট মারা যান তিনি।

মোঃ মোশারেফ হোসেনঃ

১৯৪৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রামগতি উপজেলার বালুরচর এলাকায় জন্মগ্রহন করেন তিনি। ১৯৯৮ সালের উপনির্বাচনে জাসদের প্রার্থী হিসেবে লক্ষ্মীপুর -৪ (রামগতি) র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৪ সালে কৃষকলীগে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষনা সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষন নেন। প্রশিক্ষন শেষে তিনি রামগতি-হাতিয়া অঞ্চলের বিএলএফ জোনাল কমান্ডার হন।

আবদুর রব চৌধুরীঃ

লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের দু’বারের সাংসদ ছিলেন। ১৯৫৪-৫৫ সালে হয়েছেন ঢাকসু’র জিএস। ১৯৫৬ সালে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসপি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি আমলা হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। চাকুরী জীবনে একাধিক জেলার প্রসাশক (ডিসি), উপসচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় রিলিফ কমিশনার, ১৯৭২ সালে দেশের প্রধান রিলিফ সমন্বয়কারী হন। ১৯৭৩ সালে কৃষি মন্তনালয়ের সচিব হন এবং ১৯৭৪ সালে সরকারী চাকুরী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে আইন পেশায় যোগ দেন। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী হিসেবে দেশব্যাপী খ্যাতি পেয়েছেন।

এবিএম আশরাফ উদ্দিন নিজানঃ

এবিএম আশরাফ উদ্দিন নিজান ১৯৫৭ সালের ৩০জুন রামগতি উপজেলার চরআলগী ইউনিয়নের চরটগবীতে জন্মগ্রহন করেন। তিনি ২০০১ এবং ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি থেকে দু বার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৮ সালে মৎস্য ও প্রানি সম্পদ মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হন। বর্তমানে তিনি বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শফিউল বারী বাবুঃ

শফিউল বারী বাবু রামগতি উপজেলার চর আলগী ইউনিয়নের পুর্ব চর আলগীতে জন্মগ্রহন করেন। শফিউল বারী বাবু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সাধারন সম্পাদক, স্বেচ্ছাসেবকদলের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্র রাজনীতিতে থাকাকালীন তরুনদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হন বাবু। কথিত আছে রামগতি-কমলনগরে অসংখ্য যুবককে চাকুরী পেতে ব্যাপক সহায়তা করেছেন। ২০২০সালের ২৮জুলাই  ফুসফুসে প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

মোঃ আবদুল্যাহ আল মামুনঃ

শিল্পপতি মোঃ আবদুল্যহ আল মামুন ১৯৫৬ সালের ৭আগস্ট রামগতি উপজেলার বড়খেরীতে জন্মগ্রহন করেন। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের মনোনয়ে লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন ২০১৪ সালে। মেঘনার ভাংগন রোধে বেড়ীবাঁধের কাজ করে সাধারন মানুষের কাছে হয়েছেন বেশ জনপ্রিয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও জোটের কারনে প্রার্থীতা ছেড়ে দেন তিনি।

মাহফুজুল বারীঃ

বাংলাদেশের দক্ষিন অঞ্চলের জেলা বৃহত্তর নোয়াখালীর রামগতি থানার কয়েকজন কৃতি সন্তান। তার মধ্যে মাহফুজুল বারী ছিলেন একজন। বারীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযাত্রী, আগরতলা মামলার ২২নং আসামী। আগরতলা মামলা ছিলো স্বাধীনতার মুল পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনায় মাহফুজুল বারী ছিলেন পরিকল্পনাকারীদের একজন। তিনি আগরতলা মামলার ২২ নম্বর আসামি ছিলেন এবং ২ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু তাঁকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নিয়ে আসেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন মাহফুজুল বারী। কলকাতা হয়ে পরে কানাডায় গিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সাবেক সদস্য ছিলেন মাহফুজুল বারী। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগেরও সাবেক সাধারণ সম্পাদক তিনি। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ২৩ উদীচী কানাডা সংসদের উপদেষ্টা মাহফুজুল বারী  রাজধানীর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এছাড়া আরো বেশ কয়েকজন জাতীয় রাজনীতির ছায়াতলে থাকলেও তাঁদের আরো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে বলে মনে করি। এর মধ্য উল্লেখযোগ্য হলেনঃ মোঃ আবদুজ্জাহের (সদস্য, যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক উপ কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ); তাসভীরুল হক অনু (সহ সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর, দক্ষিণ, বাংলদেশে আওয়ামীলীগ)। বর্তমান পদ পদবী ও বয়স বিবেচনায় উনাদের পক্ষে হয়তো ডিশিসান মেকারের রাজনৈতিক পদ পদবিতে যাওয়া কঠিনই বলে মনে করি।

কমরেড তোয়াহা বাম রাজনীতির পুরোধ। রামগতি-লক্ষ্মীপুর সড়ক নির্মানের তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় রাজনীতিতেও তাঁর অংশগ্রহন ছিলো বেশ দাপুটে। তাঁর জন্মস্থান লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলায়। বর্তমান সাংসদ মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নান রামগতি উপজেলায় নানান কারনে জনপ্রিয় এবং জাতীয় রাজনীতিবিদ হলেও তাঁর জন্মস্থান নোয়াখালীর সদর উপজেলায়। ফরিদুন্নাহার লাইলী আওয়ামীলীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক। সংরক্ষিত আসনে রামগতি-কমলনগরে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও উনার জন্মস্থানও নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলায়।

উল্লেখিত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যেতে পারে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে রামগতির নেতৃত্ব আাগামী এক দশক নাও দেখা যেতে পারে। আর এমন শূন্যতা একজন রামগতিবাসী হিসেবে আমার আপনার সবার জন্য হতাশার বিষয়।

(লেখাটি লিখতে লক্ষ্মীপুর ডায়েরীসহ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ, উইকিপিড়িয়া, ইন্টারনেট এর সাহায্য নেয়া হয়েছ।)

লেখকঃ

সম্পাদক, দেশালোক ডটকম বেসরকারি শিক্ষক