রামগতিতে এবার ৪৩ ইটভাটা: জনজীবনে মারাত্মক হুমকির শংকা

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ২:৪৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৪, ২০২৩

দেশালোক:

মৌসুমের শুরুর আগেই লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে প্রস্তুত করা হয়েছে ৪৩ টি অবৈধ ইটভাটা। এর মধ্যে পুরাতন ৩২ ভাটার সাথে নতুন মৌসুমে যুক্ত হচ্ছে আরো ১১টি। ইতিমধ্যে ৪৩ টি ইটভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরি করতে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন ভাটার মালিকরা। গত এক সপ্তাহে ৫টি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্টরা। বাকিগুলোয় আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই শুরু করবে। এসব ইটভাটার সবগুলোতেই পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ইট পোড়ানোর জন্য কাঠ সংগ্রহে গ্রামে গ্রামে চলছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেনা-বেচা। শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন শ্রেনির শ্রমিক নিয়োগে চলছে অগ্রিম দাঁদন।

কার্যক্রম চালু থাকা ইটভাটার কোনটিরই নেই সঠিক অনুমোদন কিংবা বৈধ কাগজপত্র। স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন পক্ষকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব ভাটা। ভাটাগুলোর মালিকদের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় একশ্রেণির প্রভাবশালী। কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই প্রতি বছরই কোন না কোন ইউনিয়নের ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে এসব ভাটা। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে বিপন্ন বিস্তীর্ণ জনপদের মানুষজনের মধ্যে শুরু হয়েছে চরম আতংক।

এদিকে কৃষি যন্ত্রপাতির ক্রয়ের ভর্তূকির সরকারি সুবিধা নিয়ে কেনা ভাটা মালিকদের প্রায় তিন শতাধিক অবৈধ ট্রাক্টর ট্রলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো উপজেলা। এর ফলে গ্রামীণ জনপদে সামাজিক অবকাঠামো রাস্তাঘাট ভেঙে সৃষ্টি হচ্ছে নানা বিপর্যয়। ক্ষত-বিক্ষত করছে গ্রামীণ কাঁচা, পাকা ও আধাপাকা সড়ক। এবছর গ্রামীণ সড়কগুলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করছেন সচেতন মহল। ধূলোবালির প্রভাবে নানান রোগের সংক্রমনসহ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যূঝুঁকিও রয়েছে।
জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আয়তন ৩৪৭ বর্গ কিলোমিটার। এ স্থল আয়তনের তিন ভাগের একভাগ মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আটটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলা। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, এ উপজেলায় সর্বমোট ৪৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি ভাটা সাময়িক বন্ধ থাকলেও এ বছর আবার নতুন করে শুরুর প্রক্রিয়া চলছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ মাত্রাতিরিক্ত ইটভাটার ফলে বিষিয়ে ওঠছে তাদের জীবনযাত্রা ও স্বাভাবিক বসবাস। নানা জটিল রোগে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে এলাকার শিশুসহ নানা বয়সী লোকজন। দেদারছে এসব ইটভাটায় প্রকাশ্য কাঠ পোড়ানো হলেও কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় একদিকে এলাকার বনজ সম্পদ কমিয়ে আসছে অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে মারাত্মকভাবে। অপরদিকে নির্বিচারে কাঠ পোড়ানোয় ধ্বংস হচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির গাছগাছালি। ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি ‘টপসয়েল’ বিক্রিতে হ্রাস পাচ্ছে জমির উর্বরতা শক্তি। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি ভাটাতেই শ্রমিক হিসেবে যুক্ত আছে শিশু শ্রমিক। ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে আছে মামলা হামলার অভিযোগও। প্রায় প্রতিটি ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে রয়েছে শ্রমিক নির্যাতন, চেক জালিয়াতি এবং মামলা হামলার অভিযোগ।
অভিযোগ রয়েছে, এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একাধিক লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হলেও প্রশাসনের জোরালো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। এ সুযোগে বেপরোয়া ইটভাটাগুলোর মালিকপক্ষ। ইটভাটা তৈরিতে একদিকে যেমন কৃষি জমি ধ্বংস করা হচ্ছে অন্যদিকে দখল করা হচ্ছে সরকারি খাল, ভূলুয়া নদী ও খাসজমি। এসব ভাটায় যানবাহন যাতায়াতে তৈরি করা হচ্ছে অবৈধ সড়ক। জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত থাকায় খাল-নদী দখল করে দেয়া হচ্ছে রাস্তা তৈরির নতুন নতুন প্রকল্প।
চররমিজ এলাকার সিরাজুল ইসলাম, চরআলগী ইউনিয়নের আব্দুল কাদের ও চর নেয়ামত এলাকার মফিজ মিয়া জানান, ইটভাটা মালিকদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কাছে উপজেলা প্রশাসন অসহায়। অভিযান চালিয়ে চিমনি ভেঙ্গে আগুন নিভিয়ে দেয়ার পরও পুনরায় চালু হচ্ছে ভাটার আগুন। গত বছরের ডিসেম্বরে উপজেলার ১১টি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে চিমনি ভেঙ্গে আগুন নিভিয়ে দেয়াসহ সাড়ে ৯লক্ষ টাকা জরিমানা ও একজনকে কারাদন্ডাদেশ দেন উপজেলা ভ্রাম্যমান আদালত। এছাড়াও প্রায়ই এসব ইটভাটায় বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এতো কিছুর পরেও ইটভাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সচেতন এলকাবাসী এসব অবৈধ ইটভাটা স্থায়ী ভাবে বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতনের হস্তক্ষেপ দাবি করছেন।

উপজেলার সবগুলো ইটভাটা দেখভাল করেন ‘রামগতি উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতি ও কর্মসংস্থান ব্যুরো’ নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা চল্লিশটি ইটভাটা মালিক। সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খলিল উল্যাহ এবং সাধারণ সম্পাদক হচ্ছেন সানা উল্যাহ। তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে ইটভাটার প্রকৃত তালিকা ও তথ্য দিতে তালবাহানা করেন। বহুপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্থ করে অল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফার লোভে গড়ে উঠা এসব ইটভাটার মালিক ও অংশীদারদের মধ্যে মামলা-হামলা, ভূমি জবরদখল, সরকারি ভূমি দখল, খাল-নদী দখল করে ভাটা ও সড়ক নির্মানসহ নানান অভিযোগ রয়েছে।
ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও বিএনপি নেতা খলিল উল্যাহ’র সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার কথা বলতে চাইলে তিনি সবগুলো ইটভাটার সবধরনের অনুমতি আছে বলে লাইন কেটে দেন। অন্যদিকে কথা বলতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক সানা উল্যাহ ব্যস্ত আছেন বলে তিনিও ফোন কেটে দেন।
রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেন জানান, তিনি এ উপজেলায় নতুন এসেছেন। তবে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া আশ্বাস দেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানান, ইউএনও ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাথে কথা বলে এসব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন।