ব্যক্তির নির্ভরশীলতা আজীবন

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৬:০৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০২১

মারজাহান আক্তার:

ষাটের দশকে এ.জি. ফ্রাংক মানুষের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাকে বিশ্ব পুঁজিবাদ বা ধনতান্ত্রিক শোষণের রুপ দিয়ে বোঝান। কাছাকাছি ভাবে শোষণের রুপকে আরো বুঝান ম্যাটস, প্রিফিন, পল ব্যারন সহ প্রমুখ সমাজবিজ্ঞানীগণ। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দিয়ে দুনিয়াবি জীবন শুরু এবং নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে দুনিয়া হতে বিদায় তাই আমি “ব্যাক্তির সমগ্র জীবনব্যাপী নির্ভরশীলতাকে” দেখাব পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টি কোন থেকে। অর্থ্যাৎ একজন ব্যক্তির ভ্রুনের বিকাশ হতে শুরু করে অন্ত্যষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা পর্যন্ত পুরো সময়টাই নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। একা বা এককভাবে ব্যক্তি কখনই বেঁচে থাকতে পারে না। আর বেঁচে থাকলে আল্লাহ ও অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া ফরজ হয়ে যায়।

আমার মতে “নির্ভরশীলতা হলো এমন এক ধরনের ভরসা রাখা বা আস্থা স্থাপনের জায়গা যা ব্যক্তির জীবন চলাকে সহজ করে দিয়ে তাকে বেঁচে থাকতে ও জীবন চালিয়ে নিতে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।”

ভ্রুন যখন হয় তখনও ভ্রুন হওয়ার জন্য ডিম্বানুকে নির্ভর করতে হয় শুক্রানু বা স্পার্ম এর উপর বা শুক্রানুকে নির্ভর করতে হয় ডিম্বাণুর উপর অর্থ্যাৎ একে অপরের উপর নির্ভরতার মধ্য দিয়ে ভ্রুণ হয়। স্পার্ম এলে তা ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে নিষিক্তি হলে তা জাইগোট তথা ভ্রুণ এ পরিণত হয়। ভ্রুন টি বহু ধাপ ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে শিশুতে পরিণত হয়। ভ্রুন হতে শুরু করে পরিপূর্ণ শিশুর রুপ নিতে তাকে নির্ভর করতে হয় কোন এক নারীর পেট বা গর্ভে। নারীর গর্ভ হতে দুনিয়ায় আসতে বা তার গর্ভপাত হতেও তাকে নির্ভর করতে হয় মা, দাই, নার্স, ডাক্তারসহ অনেক মানুষের উপর। দুনিয়ায় আসার পর নিজ হাতে নিজের সকল স্বাভাবিক কর্ম না করতে পারা পর্যন্ত তার সমস্ত নির্ভরতা স্বাভাবিক ভাবে থাকে প্রধাণত মায়ের উপর অর্থ্যাৎ মাই মূখ্য ভূমিকা পালন করে। আর গৌণ ভূমিকায় প্রধান বাবা থাকে সাথে থাকে দাদা-দাদী, ফুপু, চাচা, নানা-নানি, খালা, মামাসহ আরো অনেকে। মা-বাবা ছাড়া বাকিদের সংশ্লিষ্টতা নির্ভর করে সময় বা পরিবেশের উপর। অর্থ্যাৎ শিশুটির নির্ভরতা কার উপর কতটা থাকবে বা হবে সেটা নির্ভর করে তার বেড়ে উঠাকালীন সময়ের ও পরিস্থিতির উপর। শিশুর সুস্থভাবে বৃদ্ধি হওয়ার জন্য বেশির ভাগ সময়ই সে প্রধাণত মা বা কোন না কোন পরিবারের আশ্রয়ে বা অন্য কোন আশ্রয়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। তবে এই সময়টায় শিশুর নির্ভরতা বেশির ভাগই থেকে কোন কোন পরিবার বা অভিভাবকের উপর।

ধীরে ধীরে শিশুর নির্ভরতা শুরু হয় খেলার সাথীর উপর তারপর পরিবারের গন্ডি ছাড়িয়ে সমাজের উপর যেমন: খেলার সাথী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর। এসবের উপর শিশুর নির্ভরতা শিশুর বুদ্ধিভিত্তিক বিকাশকে বিকশিত করে থাকে অনেক বেশি। সময়ের পরিক্রমায় শিশুটি কৈশোর, যুবক হওয়ার দিকে যখন এগিয়ে যায় তখন সে ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের গন্ডি ছাড়িয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীল হতে থাকে বা নির্ভরশীল হয়ে জীবনকে চালিত করে তবে মূখ্য নির্ভরতা থাকে পরিবার বা অভিভাবকের উপর সেখানেই পাওয়া যায় নিঃস্বার্থভাবে মানব জীবনের অপরিহার্য উপাদানের পূর্ণ সহায়তা যথা: নিঃস্বার্থ অর্থনৈতিক সাপোর্ট, মায়া-মমতা, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, সাহসিকতা, দুঃর্দিনের আশ্রয়স্থলতা সহ আরো অনেক কিছু। যা পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও বা করোর কাছেই নিঃস্বার্থ ভাবে পাওয়া যায় না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কতটা ভালো কর্মের উপযোগী হবে তা নির্নয় করা যায়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা কর্মমুখী শিক্ষা শেষে সে ভালো কর্মের উপযোগী হয়ে উঠলে অভিভাবকের উপর তার অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমে আসে। তবে তখনও সে তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য তাকে নির্ভরশীল থাকতে কোন না কোন কর্ম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উপর যদিও কর্মটা ব্যক্তির জ্ঞান ও পরিশ্রমের উপর নির্ভরশীল থাকে।

ব্যক্তি জীবনের একটা বড় সময় কর্মের উপর নির্ভরতার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলেও পাশাপাশি তাকে পরিবার বা কোন আশ্রয়ের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। পাশাপাশি সুস্থ থাকার জন্য তাকে নির্ভর করতে হয় সমাজের ‘সকল শ্রেণির শ্রমজীবি’ মানুষের উপর। কারন একজন মানুষ তার জীবনকে সুস্থ-সুন্দর ভাবে চালিয়ে নিতে যেসব মৌলিক ও জৈবিক চাহিদা আবশ্যক বা একান্ত অপরিহার্য তার প্রায় সবগুলোর জন্য তাকে সকল কর্মজীবি মানুষের উপর সর্বদাই নির্ভরশীল থাকতে হয় যা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।

এছাড়া ব্যক্তি জীবনে আরেকটি অপরিহার্য উপাদান হলো সেবা। এই সেবা নেয়ার জন্য ব্যাক্তিকে সর্বদা বা সর্বাবস্থায় পরিবার বা অন্য কোন মানুষের উপর নির্ভরশীল তো থাকতেই হয় কেননা মানুষ মাত্রই পারিবারিক বা সামাজিক জীব। ব্যক্তির এই নির্ভরতা ছাড়া তার পক্ষে কখনই সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব পর হয় না। বিশেষত শিশু অবস্থায়, অসুস্থ হলে, জৈবিক চাহিদা পূরণ, একটু বয়স বা অধিক বয়স হয়ে উঠলে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থ্যাৎ শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত নিঃস্বার্থ আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সেবা ইত্যাদি ইত্যাদির জন্য নির্ভরশীল হয় পরিবারের উপর।

নির্ভরতার মধ্য দিয়ে জীবন শুরু হয় বলে ব্যক্তির পুরো জীবনের প্রতিটি কদম বা কাজ নির্ভরতার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয় যাকে সমগ্র জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া বললেও বোধ হয় ভুল হবে না। এই নির্ভরতা কারোর উপর না হলেও মহান আল্লাহর উপর তো অবশ্যই। এমনকি মৃত্যুর জন্যও ব্যক্তির নির্ভরতা থাকে মহান আল্লাহতায়ালা হুকুম ও জিব্রাইল (আ) এর উপর। আর মরে গেলে তো অন্যের উপর নির্ভরশীলতা হয়ে যায় শিশুর মতো কারন তখন তো নিজের কোন সক্ষমতাই থাকে না। নিথর দেহটি সমাধিস্থ হয় অন্যের নির্ভরতায় তথা পরিবারিক, সমাজিক আবার অনেক সময় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়।

লেখক: ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী এবং এমফিল গবেষক, নোয়াখালী