পরিবারই নৈতিকতা ও মূল্যবোধ  শিক্ষার সুতিকাগার

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১২:২৮ অপরাহ্ণ, মে ১৮, ২০২১

মারজান আক্তার: পরিবার হলো তা “যেখানে দুই জন নারী-পুরুষ ধর্মীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে একত্রে বৈধ ভাবে বসবাস করে সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন এর মাধ্যমে পরিবার গঠন করে সমাজে স্থায়ীভাবে বাস করে থাকে”। আমাদের সমাজে স্বাভাবিক নিয়মে পরিবারের প্রধান হল বাবা-মা।

নৈতিকতা হলো “সমাজ ও মানুষের সুস্থ-সুন্দর জীবন চলার নিয়ম-নীতি যা যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসুলগণের মাধ্যমে মানবজাতিকে শিখিয়ে দিয়েছেন”।

মূল্যবোধ হলো “সমাজে প্রচলিত (ধর্মীয়) নিয়ম-নীতির মধ্যে ভালোগুলোকে ভালো বলে গ্রহন এবং মন্দগুলোকে মন্দ বলে বর্জন করার মনোভাব”।

পৃথিবীতে মানব বসতির অস্তিত্বের আগে আদম- হাওয়ার মাধ্যমে পরিবারের ধারণা পরিলক্ষিত হয়। যার প্রেক্ষিতে সহজাত বা স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীতে মানব শিশুর আগমন কোন না কোন পরিবারে হয়ে থাকে। এমনকি প্রত্যেকটি মানুষের নবজাতক হিসেবে আগমন মুসলিম হিসেবে এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে ” প্রত্যেক নবজাতক স্বভাব ধর্মের উপর জন্ম গ্রহন করেন। অতঃপর তাঁর পিতামাতা তাকে ইহুদী খ্রিষ্টান বা অগ্নি পূজারক হিসাবে গড়ে তোলেন বা বানান ( সহীহ বুখারী: ১৩৮৫)”। পরিবারের মাধ্যমে মানব শিশুকে সঠিক মানুষ তথা ভবিষ্যতের ভালো মানুষে পরিণত করে তুলতে আল্লাহ তায়ালা পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, চাচা ফুফুসহ আরো অনেকে একত্রে বসবাস করে থাকে।

আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাই যাঁরা আমাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন তাঁরা সমৃদ্ধ পরিবারের বা বংশে জন্ম নিয়ে ছিলেন। শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) জন্ম বুনিয়াদি পরিবার বা বংশে এবং তখনও আরব সমাজে ভালো ও মন্দ পরিবার বিরাজমান ছিল। সময়ের ব্যবধানে খারাপ পরিবারের বৃদ্ধির সাথে সাথে ভালো বা বুনিয়াদি পরিবারগুলো অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। আজ থেকে প্রায় একশ-দেড়শ বছর আগেও বুনিয়াদি বংশ ছিল গৌরবের। বংশের এতই কদর ছিল যে কারনে তখন বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গেলে(সুন্দর, লম্বা, উচ্চশিক্ষিত, টাকাওয়ালা বাবার মেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি খুঁজত না) জাত বা ভালো বা উচ্চ বংশ খুঁজত, বলা হত “জাতের মেয়ে কালোও ভালো “। যার লক্ষ্য একটাই ছিল ওই মেয়ে ভালো বংশের পারিবারিক শিক্ষার কারনে সে ভদ্র হবে তার আচরণ ভালো হবে এবং তার থেকে যে মানব শিশুর আগমন ঘটবে সে ভালো হবার সম্ভাবনা বেশি বা ভবিষ্যৎ ভালো বংশধর এর জন্ম দিবে । প্রযুক্তির যুগে এসে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কাছে সেই বলশ গুরুত্ব এখন একেবারে মূল্যহীন বা মৃতপ্রায়।

বর্তমান সময়ে বিবাহের ক্ষেত্রে বংশের গুরুত্বকে অবহেলায় উড়িয়ে দেবার কারনে ২০২১ সালের বেশির ভাগ পরিবারগুলো হয়ে গেছে “মিশ্র পরিবার (বংশ)”। যেখানে ভালো মানুষের চেয়ে, মন্দ মানুষের হার বেশি। আমার মতে মিশ্র বংশ গড়ে উঠার পেছনে যে বিষয়টি মূখ্য ভূমিকা রাখে চলেছে তা হলো ‘টাকা’। কেননা প্রযুক্তির যুগে মানুষের বেঁচে থাকার ‘প্রধান অবলম্বনই হলো টাকা’। এই টাকা উপার্জনের সহজ কিছু মাধ্যম রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যবসা, বিদেশ গমন ইত্যাদি। টাকা উপার্জনের এই ক্ষেত্র গুলো সকল মানুষের জন্য উন্মুক্ত শুধু বুনিয়াদি বংশের লোকের জন্য নয়। যার কারনে বর্তমানে বিয়ের ক্ষেত্রে বংশ নয় এগুলোর যেকোন একটা থাকলেই হয় অর্থ্যাৎ পাত্র বা পাত্রীর পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতাটাই অগ্রাধিকার সাথে থাকে সুন্দর, লম্বা, প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা। বর্তমানে বেশির ভাগ পরিবারগুলো মিশ্র পরিবার (বংশ) হওয়ার কারণে ভালো মানুষ তৈরি হওয়ার সংখ্যা অনেক কমে গেছে কারন শয়তানের কারনে মানুষের মধ্যে ভালো বিষয় গ্রহন করে ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে খারাপ বিষয় গ্রহণ করে খারাপ হওয়ার প্রবণতাই বেশি যা আমরা দেখছি এবং বিশ্বাস করছি। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় আগে বুনিয়াদি পরিবার হতে খারাপ মানুষ হতো দুই একজন যাদেরকে ‘বংশের কলঙ্ক’ বলে চিহ্নিত করা হতো। আর বর্তমান সময়ে মিশ্র পরিবার হতে ভালো মানুষই তৈরি হয় ‘দুই একজন’ যা আগের তুলনায় সম্পূর্ন বিপরীত চিত্র।

সন্তানের দেহে বাবা-মার যীন প্রবাহমান থাকে বলে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন বাবা-মা আচরণের বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খারাপ হলে তাদের অনুগত সন্তানরা একই রকম খারাপ কাজই বা অন্যায় করে থাকে। যা বাবা-মার যীনগত কারনের জন্য হয়। তাই বাবা- মা খারাপ কাজ করলে তাদের সন্তানরা সেই কাজ না করে থাকতে পারে না আর এই জন্য বলা হয় চোরের সন্তান চোরই হয়, অন্যায়কারীর সন্তান অন্যায়কারী, জেনা-ব্যাভিচার কারীর সন্তান জেনা-ব্যভিচারীই হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

পরিবার মানে বাবা-মা তো যেখানে বাবা-মাই খারাপ সেখানে সন্তানকে কে, কিভাবে, কি ভালো শিক্ষা দিবে? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন “তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে ভালোবাসা দিবে এবং সর্বোচ্চ শিষ্টাচার ও নৈতিক শিক্ষা দিবে দিবে(ইবনে মাজাহ-৩৮০২)”। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ” হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার পরিজন দেরকে জাহান্নামের আগুন হতে হেফাজত কর(আত-তাহরিম-৬)”। হযরত আলী (রা:) এই আয়াতের প্রেক্ষিতে বলেছেন ” তোমরা নিজেরা শিখ ও পরিবার বর্গকে শিখাও সমস্ত কল্যাণময় রীতিনীতি এবং পরিবার বর্গকে সে সব ভালো কাজে অভ্যস্ত করে তোল। সন্তানদের উন্নত মানের ইসলামী আদর্শ শিক্ষাদান ও ইসলামি আইনকানুন পালনে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় এমনকি রাসুল (সা:) কে অনুসরণ করে চলার জন্য অভস্ত্যতা তৈরি করে তোলাই পিতামাতার কর্তব্য। এখন আপনারাই বলেন বর্তমান বাংলাদেশের সমাজ-ব্যবস্থায় পরিবারে বা বাবা মার কাছে তা কতটুকু আছে? বা তারা তাদের সন্তানদের এই বিষয়ে শিক্ষা দিতে কতটা আগ্রহী? এছাড়া বাবা-মা যদি খারাপ হয় সন্তান তাদের কাছ থেকে কি শিষ্টাচার ও নৈতিক শিক্ষা পায়? তা নাই বা পায় না বলে ২০২১ সালের বাংলাদেশের মানুষের মধ্যকার নৈতিকতা রয়েছে সর্ব নিন্ম পর্যায়ে। এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে, হচ্ছে শতভাগ।

সন্তান যখন ছোট থাকে তখন সে থাকে নরম মাটির( নরম মাটি দিয়ে যা বানাতে ইচ্ছে করে তাই বানানো সম্ভব যেটা ছোট বেলায় আমরা দেখেছি কেনন এটি আমাদের খেলার অন্যতম উপকরণ ছিল) মত বাবা-মা তাকে যেভাবে গড়তে চাইবে সেই ভাবে তাকে গড়ে উঠাতে পারে। তাই পরিবার বা বাবা-মা সন্তানকে ছোটবেলা হতেই যদি ভুল শিক্ষায় গড়ে তোলে, ভুল পথে পরিচালিত হতে অভ্যস্ত করে তোলে ( ভুল পারিবারিক শিক্ষা) তাহলে বড় হলে তাকে কখনও সেই পথ হতে ফিরিয়ে ভালো করে তোলা সম্ভবপর নয়। আবার অনেক সময় দেখা যায় পারিবারিক শিক্ষা ভালো পেলেও সঙ্গদোষ, পারিপার্শ্বিক কারনে অনেকে খারাপ হয় তবে এদের আবার ভালো হওয়ার সম্ভবনাও বেশি থাকে।

পরিবারে সন্তানকে শিক্ষা দানের জন্য বাবার ক্ষেত্রে রাসূল বলেছেন, “উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষাদানের চেয়ে বড় দান কোন বাবা তার সন্তানের জন্য করতে পারেনি (তিরমিজি-২০৭৯)”। অথচ ২০২১ সালের বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘বাবার হাতে কন্যা সন্তানদের ধর্ষণের’ চিত্র। বাবাই যখন নোংরা ঘৃন্য চরিত্রের অধিকারি তখন সন্তানরা কি শিষ্টাচার শিখবে? তো সন্তানের চরিত্রও নোংরা হবে, হবে না কেন? আর এজন্যই সন্তানরা পরিবার ও বাবা-মার সাহচার্যে থাকা স্বত্ত্বেও আজকের সমাজে নোংরা মানুষের সংখ্যা যেমন অনেক অনেক বেশি তেমনি তাদের নোংরা সকল কাজের বিজয় ধ্বনি অনেক বেশি যা আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিনিয়ত।

এছাড়া পরিবার হতে সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার জন্য রাসূল বলেছেন, “সন্তানদেরকে নবীর প্রতি ভালোবাসা, তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও কোরআান তেলাওয়াত শিক্ষা দাও( জামিউল আহাদিস-৯৬১)”। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের তথাকথিত আধুনিক পরিবারগুলো এসব শিক্ষা বাদ দিয়ে, কিভাবে সন্তান ভবিষ্যতে অনেক বেশি টাকা উপার্জন করার সক্ষমতা অর্জন করবে শিশু বয়স হতে সেই শিক্ষাই প্রদান করে আর সেসব বাবা-মা গর্ববোধ করে আমি আমাদের সন্তান আপডেট। আর যেসব বাবা-মা ধর্মীয় বিষয়ে এখনও সন্তানদের শিক্ষা দেন তাদেরকে বলে বেকডেটেড। আপসোস, আপটেডেট বাবা-মা তাদের জীবনে এই নৈতিক শিক্ষাটুকুও অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে যে ” কেয়ামত পর্যন্ত নবী-রাসূলগণ হতে প্রাপ্ত শিক্ষা ও কোরানের শিক্ষা সর্বদা, সর্বাবস্থায় আপডেট বেকডেটেড নয়”।

তাই পরিবার তথা বাবা-মা কে তাদের সন্তানদের সঠিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে শিশু বয়স থেকেই এবং তাদের মধ্যে অভস্ত্যতা তৈরি করার পরিপূর্ণ দায়িত্বও নিতে হবে। কারন পরিবার তথা বাবা-মা তার সন্তানকে যা শিখিয়ে অভ্যস্ত করতে পারবে বা তার সন্তানের মধ্যে তৈরি করে দিতে পারবে তা অন্য কারোর দ্বারাই কখনই সম্ভব পর হবে না।

সমাজ, রাষ্ট্র ব্যক্তির জন্য নৈতিক ও মূল্যবোধ শিক্ষার ব্যবস্থা করলেও আমার মতে পরিবারই তথা বাবা-মাই হলো সন্তানের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষার সুতিকাগার। শিশুদের মধ্যে নৈতিকতা বিরোধী কাজ, কিশোর অপরাধ ও আনুশকা, মুনিয়ার মত আরো অসংখ্য অগুনিত সন্তানদের নৈতিকতাহীন কাজের জন্য বাবা-মাই প্রধানত দায়ী বলে আমি মনে করছি। তাই প্রয়োজনে পরিবার তথা বাবা-মার জন্য আগে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারন পরিবার তথা বাবা-মা হতেই শিশু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা পায়, অভ্যস্ত হয়। শিশুকে একবার নৈতিকতায় অভ্যস্ত করে তুলতে পারলে তার দ্বারা বাকী জীবনে অনৈতিক কাজ হবার সম্ভবনা থাকবে খুবই কম। আর পরিবার তথা বাবা-মা সন্তানকে যদি নৈতিক শিক্ষায় অভ্যস্ত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে বর্তমান সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীনতার আরো তলানীতে পৌঁছানো , সর্বত্র নোংরা পরিস্থিতির বিরাজমান অবস্থা এবং নোংরা মানুষের নোংরা আচরণ, নোংরা কাজের বিজয় দেখা অব্যাহত থেকে উত্তোরত্তর বৃদ্ধি পাওয়া কোনভাবে ঠেকিয়ে যে রাখা যাবে না এতে কোন সন্দেহ নেই।

 

লেখক: ক্ষুদে সমাজ বিজ্ঞানী ও এমফিল গবেষক, নোয়াখালী