একাকিত্বের মৃত্যু আর কতো!

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৫:৫২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৯, ২০২১

সারোয়ার মিরন: সভ্যতার এ উন্নত সময়ে আমরা বেঁচে আছি অনেক ভাবেই। রোগে শোকে কাতর বিশ্ব। এসব মারি মহামারির ফাঁক ফোঁকর গলে আমরা বেঁচে থাকছি। বলতে গেলে কোন মতে আছি! যান্ত্রিক এ সময়ে সমাজ কিংবা পরিবারবদ্ধ হয়ে বসবাস করার যৌক্তিকতা প্রবল প্রয়োজন হলেও তার বাস্তবিক প্রয়োগ ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে। আমরা হয়ে উঠছি প্রচন্ড রকমের যান্ত্রিক দানব।

আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ছে আমাদের। বহু বৃত্তের পরিবার আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়াতে প্রানপণ চেষ্টা আমাদেরকে বহুমুখী যন্ত্রনা বেড়েই চলেছে। উন্নত জীবনের খোঁজে চলতে গিয়ে আমরা ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছি। জীবনবোধের উপলব্ধির পারদ মারাত্মক রকমের বিপর্যয়ে। এ কেমন যাত্রার সূচনা।

পরিবার সমাজ দেশ যতটা উন্নত হচ্ছে, আধুনিকতার ছায়ার পরিধি ঠিক যতটা বাড়ছে ঠিক উল্টোটা ঘটছে আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা না! গতো কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি মৃত্যু আমাকে ভীষন ভাবিয়ে তুলছে! চিন্তার জগতকে সংকুচিত করে তুলছে একাকিত্বের ভাবনায়।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আর্থিক অবস্থা ও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের পরিবার পরিজন ও সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ জায়গাটায় যেন আমরা বন্ধন হারিয়ে ফেলছি! অদ্ভুদ এ পৃথিবীতে এখন ধন সম্পদের পরিবর্তে মানবিক হৃদয় বড্ডো বেশি প্রয়োজন। আমরা ভুলে গেছি জীবনের শেষ সময়ে সম্পদের চেয়েও বেশি প্রয়োজন এক গুচ্ছ পরম হাতের ছোঁয়া। যে স্পর্শ আমাকে আপনাকে ভোলাবে মৃত্যুুর মতো কঠিন যন্ত্রনাও!

গতো কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত মানুষের করুন মৃত্যু আমার মনো মগজে ভাবনা উদ্রেক ঘটিয়েছে। আসলে আমাদের কোনটি বেশি প্রয়োজন! মানবিক হৃদয় নাকি সম্পদের নিশ্চয়তা?

এক. পঞ্চাশোর্ধ্ব এক করোনা রোগী সুইসাইড নোট লিখে মুগদা হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। লিখে গেছেন, নিজের একাকীত্বের কথা। টাকা ছিল, পয়সা ছিল। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ছিল না কাছে। পরিবার ও আত্মীয়দের সবাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ “উন্নত” দেশে! একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন বলে লিখে গেছেন!

দুই. চলচ্চিত্রের নায়িকা, সাবেক সাংসদ কবরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। মারা যাওয়ার পর তার একটি সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ ভাইরাল হয়েছে। তা হলো, জীবনে ভালো একজন বন্ধু পেলাম না, ভালো একজন স্বামী পেলাম না, সন্তানরাও যে যার মতো! কারো সাথে বসে এক কাপ চা খাবো, মনের কথা খুলে বলব- তা পেলাম না!

তিন. “বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর” লেখক, খ্যাতনামা কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর তারেক শামসুর রাহমানের লাশ নিজের বাসা থেকে দরজা, তালা ভেঙে উদ্ধার করা হয়েছে! বাসায় তিনি ছিলেন একা। স্ত্রী ও কন্যা আছেন যথারীতি “স্বপ্নের দেশ” যুক্তরাষ্ট্রে! অসুস্থ ও মৃত্যুর সময় কেউ ছিল না পাশে, কেউ জানেনি কিছু!

এভাবে আরো কিছু নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, কবি আল মাহমুদ, লেখক ও উপন্যাসিক হুমাউন আহমেদ, লেখক হুমাউন আজাদ। এ তালিকায় অসংখ্য নাম যুক্ত করা যেতে পারে। উল্লেখিত সবার একটা জায়গায় বেশ মিল। শেষ বয়সে তাঁরা ভীষন একা! একাকিত্ব তাঁদের কুরে কুরে খাচ্ছে। এঁদের কেউ কেউ জীবনের শেষ সাহাহ্নে কিংবা মৃত্যুকালীন সময়ে পরিবারের কাউকে কাছে পাননি! আবার কেউ কেউ একাকি পার করছেন পরিবার ছাড়া।

এ কেমন জীবন! সংসার! সারা জীবন যে সংসার পরিবার পরিজনের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আঁকড়ে থেকেছেন, শেষ সময়ে এসে তারাই দুরে সরে যাচ্ছেন!এ কেমন প্রাপ্তী?

কি ছিলো না তাদের? টাকা, পয়সা, যশ, খ্যাতি, পরিচিতি সবই ছিল। কিন্তু কারো পাশে ছিল না স্ত্রী, স্বামী বা পুত্র-কন্যা! ছিল কেবল একাকীত্ব! অখণ্ড একাকীত্ব! যে একাকিত্ব নি:শেষ করে দিয়েছে সব পথচলা।

প্রত্যেকের মৃত্যুতে খুব কষ্ট লেগেছে। কিন্তু “উন্নত” মহলে আমাদের সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে তা ভাবতে গিয়ে আবারও শিউরে উঠেছি! হায় রে ক্যারিয়ার, হায় রে উন্নয়ন, হায় রে উন্নত বিশ্বের স্বপ্ন! হায় রে, পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা!  একটু চিন্তা করতে পারেন, একটু ভাবতে পারেন।

আহা রে জীবন! জীবনের গ্লানি!

-লেখক: সম্পাদক, দেশালোক ডটকম