রামগতি টাংকিঘাট দখল করে পুলিশ ক্যাম্প ঘেরাওঃ লক্ষ্মীপুরের দু পুলিশ কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৩:২১ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২৩

সারোয়ার মিরনঃ

নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে টাংকি পুলিশ ফাঁড়িতে মিটিং করার সময় স্থানীয় নোয়াখালীর হাতিয়া অঞ্চলের অতিউৎসাহী জনতার হাতে ৫ঘন্টা অবরুদ্ধ ছিলেন লক্ষ্মীপুরের রামগতি থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মো: আলমগীর হোসেন এবং রামগতি সার্কেল সহকারি পুলিশ সুপার সাইফুল আলম চৌধুরী।
জানা যায়, বৃহস্পতিবার বিকেল লক্ষ্মীপুরের পুলিশ কর্মকর্তারা বিকেলে টাংকির বাজার পুলিশ ক্যাম্পে আসেন। পরে তারা ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যদের নিয়ে গোল ঘরে বসেন। এর কিছুক্ষণ পরে গোল ঘরে আসেন হরনী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাইন উদ্দিন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. বাবুল হোসেন সুজন ও টাংকির বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাখওয়াত হোসেন। পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের পরে আসতে বলেন। এতেই ক্ষি্রপ্ত হয়ে ওঠেন এ তিন জন। পরে তারা স্থানীয়দের নিয়ে ক্যাম্প ঘেরাও করে পুলিশ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এসময় তারা বিভিন্ন শ্লোগানও দেন। খবর পেয়ে নোয়াখালী জেলা পুলিশের একটি টিম রাত দশটায় তাদের উদ্ধার করেন।
রামগতি থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সন্ধ্যায় আমাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে টাংকির ঘাট ক্যাম্পে যাই। ক্যাম্পে আমাদের মিটিং চলাকালে স্থানীয় মেম্বাররা এলে আমরা উনাদের পরে আসতে বলি। উনারা বাইরে গিয়ে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে উত্তেজিত করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেছে।’
রামগতি সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘টাংকির বাজার ক্যাম্পের পাশে নোয়াখালী অঞ্চলে আরও একটি আরআরএফ (রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স) ক্যাম্প রয়েছে। আমরা ক্যাম্পের গোল ঘরে রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সদের নিয়ে মিটিং এ বসার কিছুক্ষণ পর কোনো কিছু না বলে একজন লোক বসে পড়েন। আমি ওনার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি মাইন উদ্দিন মেম্বার বলে পরিচয় দেন। ‘মেম্বার ও উনার সঙ্গে থাকা লোকদের পরে আসার জন্য বললে তারা বিষয়টিকে ভিন্নখাতে নিয়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজনকে উত্তেজিত করে তুলে সহস্রাধিক লোক জড়ো করে ফেলেন। এ ঘটনাটিতে রামগতি ও হাতিয়ার সীমানা বিরোধের যোগসূত্র থাকতে পারে।’

নৈপথ্য কারন— সীমানা বিরোধঃ
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও নোয়াখালী হাতিয়া উপজেলার সাথে সীমানা সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছে দুই যুগ ধরে। জানা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে—পরে রামগতির সাথে বয়ারচরসহ দক্ষিনে মেঘনা নদীর ১০কিলোমিটার জুড়ে সীমান্ত এলাকা ছিল। এ চর একাধিকবার রামগতি উপজেলার ভূমি হিসেবে গেজেট প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে বয়ারচরকেক নিজেদের বলে দাবি করে হাতিয়া প্রশাসন গেজেট প্রকাশ করে। ২০০৯ সালের লক্ষ্মীপুরের যুগ্ম জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা হয়। সে সময় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশনা দেন আদালত।
রামগতি উপজেলার ৯নং চরগাজী ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের ভোটার তালিকায় বয়ারচরের চরগাজী, চরলক্ষ্মী, চরদরবেশ, চরদক্ষিন টুমচরসহ ছয়টি মোজার বাসিন্দারা চরগাজী ইউনিয়নের ৫,৬ এবং ৯নং ওয়ার্ডের ভোটার হন।
২০২২ সালে নোয়াখালী হাতিয়া উপজেরার হরনী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৪টি ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয় রামগতি ভূখন্ডের চরগাজী ইউনিয়নে। সে সময় হরনী ইউনিয়ন ও চর গাজী ইউনিয়ন সীমানা নিয়ে মামলা থাকায় ভোট কেন্দ্রগুলো সরিয়ে নিতে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করেন চরগাজী ইউপি চেয়ারম্যান তাওহীদুল ইসলাম সুমন।
তাওহীদুল ইসলামের করা আবেদন ও চরগাজী ইউনিয়নের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের রামগতির উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের তিনটি মৌজা নিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সঙ্গে সীমানা বিরোধ রয়েছে। এনিয়ে লক্ষ্মীপুর সাব জজ আদালতে মামলা (৭৩৯/২১) চলমান। মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদালত বিরোধীয় এলাকায় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদেশ দেন।
গত ২৪ বছরে হাতিয়া—রামগতি সীমানা জটিলতা ও বিরোধ নিয়ে অসংখ্যবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় ২০জনের মতো প্রাণ হারান। ২০০৩ সালে তৎকালীন নৌ পরিবহন মন্ত্রী আসম আবদুর রব তেগাছিয়া মোহাম্মদীয় পুলিশ ফাঁড়ি এবং বয়ারচর টাংকি বাজার অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করেন। এগুলো লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ওই থেকে প্রাণহানি ও সংঘাত কমলেও প্রায়শই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। এখানকার জনসাধারনের মাঝে এ নিয়ে সবসময় আতংক বিরাজ করে। কোন ধরনের কারন ছাড়া প্রায়ই হাতিয়ার কিছু অতিউৎসাহি মানুষ বয়ারচর এসে হামলার চেষ্টা করে।
এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মে মাসের প্রথম দিকে টাংকিবাজার মাছঘাট দখল করে নেয় হাতিয়ার লোকজন। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুরের পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বপালনকালে অবরুদ্ধ করার ঘটনায় তারই যোগসূত্র বলে মনে করা হচ্ছে।
জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওই এলাকার বাসিন্দারা লক্ষ্মীপুর—৪ (রামগতি—কমলনগর) সংসদীয় আসনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। বয়ারচরের প্রায় ১২হাজার ভোটার চরগাজী ইউনিয়নের। এসব এলাকার মানুষ গত পঞ্চাশ বছর ধরে বসবাস করছেন। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য মতে, নোয়াখালী—লক্ষ্মীপুর উপকূলীয় মেঘনা নদী ও রামগতির চরগাজীর কয়েকটি ওয়ার্ডে সাবেক এমপি মো: আলীর অনুসারিরা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। তিনি নদী ও চর সংক্রান্ত ব্যবসা বানিজ্য দখলে রাখতে বিগত দিনে জাহাঙ্গীর, বাশার, মুন্সি, গিয়াস, নিজাম, কালাবাহিনীসহ নানান সময়ে বাহিনী তৈরি করেন। এসব বাহিনী খুন, হামলা, মামলা, অগ্নিসংযোগ, চাঁদাবাজি, অপহরন, নারী নির্যাতন ও দস্যূতা চালিয়ে আসছে।