বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স এ অমানবিকতার শেষ কোথায়?

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৮:০৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১১, ২০২০

আহমদ সিরাজ: বহুবিধ আলোচনা ও সমালোচনার পরও বলা চলে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশে একটা মোড় পরিবর্তনকারী পরিবর্তন ঘটে চলেছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাতে শিক্ষার হার ও শিক্ষার মানে তাল ঠিক আছে কি-না, সামঞ্জস্যপূর্ণ আছে কি-না তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। তবে আমরা মনে করি শিক্ষাক্ষেত্রে সঙ্কট আছে – এ সঙ্কট বিকাশের সঙ্কট।

বাংলাদেশে প্রচলিত উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় বাংলাদেশের ৬০টি জেলার ৩৯২টি বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। সেখানে কমবেশি দুই লাখের মতো শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। তাতে ৩৫০০ (তিন হাজার পাঁচশত) জনের মতো অনার্স শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। এসব শিক্ষক কলেজে নিয়োগ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করেই নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপরাপর শিক্ষকরা একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত হলেও একইভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বেসরকারি কলেজের অনার্স কোর্সের শিক্ষকরা এ সুযোগ থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। মজার ব্যাপার নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘শূন্যপদ’ এর পরিবর্তে ‘সৃষ্টপদ’ বলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদ ‘সৃষ্ট’ কি ‘শূন্য’ এটা নীতির প্রশ্ন নয়, বলা যেতে পারে কৌশলের। নিয়োগ ও পাঠদান অভিন্ন হওয়াতে তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির পার্থক্য বুঝিয়ে দিয়ে কাঁধে কিংবা পিঠে কোনো নিশানা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়নি।

এ রকম  ভাবে সমগ্র বাংলাদেশে ‘সৃষ্ট’পদের নাম করে সরকার দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে তিন সহস্রাধিক শিক্ষকের জীবন ও জীবিকা বেসরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠান প্রধান ও পরিচালনা পরিষদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সে পাঠদানরত শিক্ষকরা দীর্ঘ কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি বেনিফিট ছাড়াই কর্মরত আছেন। কলেজ থেকে তাঁদের ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকার বেশি সম্মানি দেওয়া হচ্ছে না। এতে তাঁদের যাতায়াত ভাড়াও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিশ্রুত ১১০০০ টাকা সম্মানি/ভাতা দেওয়ার কথা থাকলেও একজন অনার্স কোর্সের শিক্ষক একজন শ্রমিকের সর্বনিম্ন বেতনটুকুও পাচ্ছেন না। অথচ লক্ষ্য করার বিষয় সরকারি কলেজসমূহে শিক্ষার্থীরা ২২ টাকা মাসিক বেতন দিলেও অনার্স কোর্সের ছাত্ররা ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা মাসিক বেতন দিতে বাধ্য থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ লাখ ৬১ হাজার ৪৪৬টি আসনের মধ্যে শতভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভর্তি ক্ষেত্রে বেসরকারি কলেজে প্রায় ৮৫ হাজার আসনে ৬০ হাজার শিক্ষার্থী অনার্স কোর্সে ভর্তি হয়েছে। শতকরা হিসাবে প্রায় ৭০ ভাগ। চলমান প্রক্রিয়ায় বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্সে যারা ভর্তি হয়েছে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রী দরিদ্র গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী। তারা এই উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। সরকার বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালু করাতেই তা সম্ভব হচ্ছে।

বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালু হচ্ছে বটে, কিন্তু বিগত কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে এই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা সরকারের বেতন ভাতা থেকে বঞ্চিত থাকছেন কোন যুক্তিতে তা বোধগম্য নয়! পাশাপাশি বেসরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও তাদের সরকারি সমতুল্য বেতন কলেজ থেকে দিচ্ছেন না। অথচ পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা হারে মাসিক বেতন আদায় থেকে বছরে আয় দাঁড়াচ্ছে ২৫০ কোটি টাকারও বেশি। তাতে প্রতিশ্রুত বেতনস্কেল অনুযায়ী বেসরকারি অনার্স শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ১১০০০ টাকা হিসাবে মাসিক সম্মানি/বেতন দিলেও শতকোটি টাকা অতিক্রম করে না। তাঁরা না সরকার, না প্রতিষ্ঠান কোথা থেকেও প্রাপ্তি বুঝে নিতে পারছেন না।

বলা চলে সরকারের সবচেয়ে অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে ‘শিক্ষাখাত’ এবং এ খাতের একজন সফল শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ; যিনি প্রচ- ঝড়ের মুখেও তাঁর শিক্ষাখাতকে আগলে রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন, এক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই সফল। বুঝি এ জন্য তাঁর অনেক নির্ঘুম রাতও কাটে। তাহলে এসব বেসরকারি কলেজের অনার্স কোর্সের শিক্ষকদের দাবি যদি সত্যি হয় তাহলে তার দ্রুত একটা অবসান হওয়া উচিত, না হলে তার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া জরুরি। তাছাড়া নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘সৃষ্টপদ’ কোনো বিপত্তি হয়ে থাকলে তা উঠিয়ে দেওয়া বা প্রত্যাহার করা উচিত। এসব শিক্ষকের যেহেতু নিয়োগ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যোগ্যতার কোনো ঘাটতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়নি তাহলে সরকারের শিক্ষানীতিটি কেন ‘সৃষ্ট’ কৌশলের কাছে মার খাবে? ওয়াকিবহালমহল মনে করেন, এমনকি ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষজন ভাবতে বাধ্য হবেন বেসরকারি অনার্স শিক্ষকদের সঙ্গে যা হচ্ছে তা তামাসারই নামান্তর।তাদের অবিলম্বে সরকারি বেনিফিটের অন্তর্ভুক্ত করে এই বৈসাদৃশ্যের অবসান বা পতন ঘটানো হউক।

লেখক:সদস্য, সিপিবি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটি

(সাপ্তাহিক একতা থেকে সংগৃহীত)