নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রসঙ্গে কিছু কথা

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৬:৩৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২১

মারজাহান আক্তার: নৈতিকতা হল মানব জাতির কল্যানের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম যা মানা মানবজাতির জন্য ফরজ। আর মূল্যবোধ হলো তা যা মানুষকে ভালো কাজকে ভালো বলে গ্রহন করতে ও মন্দকে মন্দ বলে বর্জন করতে শেখায়। সুতরাং নৈতিক মূল্যবোধ হল মানব জাতির তথা সমাজের কল্যানের জন্য সকল ভালো বা মঙ্গল জনক কাজ বা কাজের নিয়ম। তাই কেউ ইচ্ছে করলেই নৈতিক মূল্যবোধ না মেনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে বাস করতে পারেনা। পারলেও ব্যক্তি,সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র অরাজকতা অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে ফলে কেউ শান্তিতে পৃথিবীতে বাস করতে পারবে না।

বলছি নৈতিকতার কথা মানুষ মনে করে যে সে জন্ম মাত্রই স্বাধীন। এই স্বাধীনতার জন্য যা তার মন চাইবে যা ভালো লাগবে তাই সে করবে, তাতে অন্যের ক্ষতি হলেও তার কিছু যাবে আসেবা না তার শুধু নিজেরটাই চাই যেকোন মূল্যে। এটা বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় খুব বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের মধ্যকার এমন ধারনার প্রেক্ষিতে মানুষকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে মানবজাতি সৃষ্টির আড়াই হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ রুহ সৃষ্টি করেছেন। মানবজাতির রুহ ভ্রুন হওয়ার আগেই আল্লাহর সাথে ওয়াদা করে এসেছে দুনিয়ায় এসে রুহরুপি মানুষগুলো শুধু আল্লাহর ইবাদাত করবে। তাহলে আল্লাহর ইবাদত কিভাবে হবে? উত্তর হলো আল্লাহ যে কাজগুলো নিয়মতান্ত্রিক (নৈতিক বা ভালো কাজ) ভাবে করতে বলেছেন তা করলে, যা করতে নিষেধ করেছেন তা না করলে ইবাদাত করা হয়ে যাবে। এখন আপনারাই বলেন তো মানুষ জন্মসূত্রে কি স্বাধীন? আমার তো মনে হয় জন্ম নেয়ার আগেই মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেছে। যেখানে জন্মের আগেই স্বাধীনতা খর্ব হয়ে নিয়মে বন্দী হয়ে গেল, সেখানে জন্মগত ভাবে মানুষ স্বাধীন মন যা চাইবে যা খুশি তা করে বেড়াবে পৃথিবীতে মানুষের এমন ধারনাকে কিসের সাথে তুলনা করা যায় আপনারাই বলেন?

আপনারা একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন জীবের ভ্রুনের বিকাশ হতে মৃত্যু পর্যন্ত বা কবর দেয়া বা সমাধিস্থ করা পর্যন্ত সমগ্র জীবন একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে আবর্তিত। এই পুরো নিয়মটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত যেখানে মানুষের কোন হাত নেই। এই নিয়ম হতে আল্লাহ আমাদের এটা বুঝিয়ে এবং শিখিয়ে দিয়েছেন যে মানুষ দুনিয়ায় থাকলে তাকে এভাবে তার দেয়া আদেশ গুলো মেনে জীবনের প্রতিটি কদম নিয়মের মধ্য দিয়ে পার করতে হবে। সৃষ্টির এত বছর পরও বিজ্ঞান এটা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে আল্লাহর নির্দেশিত নিয়মগুলো মানবজাতি মানলে শুধু মানবজাতি নয় পৃথিবীতে বাসরত অন্যান্য জীবও ভালো থাকবে এবং আল্লাহ (মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁর ইবাদতের জন্য) খুশি হবেন।

আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এই নিয়মগুলো কি? নিয়মগুলো হল তা যা যুগে যুগে আল্লাহ তায়লা নবী-রাসুলগনের মাধ্যমে মানব জাতিকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সুস্থ, সুন্দর বেঁচে থাকার যেসব নিয়ম-নীতি শিখেয়ে দিয়ে গেছেন অর্থ্যাৎ নবীগন আল্লাহর নিদের্শ অনুযায়ী মানব জাতিকে যা করতে বলেছেন এবং যা করতে নিষেধ করেছেন তা করা না করাই হচ্ছে নিয়ম। এই নিয়ম আল্লাহ তৈরি করে দিয়েছেন। কেন করে দিয়েছেন জানেন? শুধুমাত্র মানবজাতি নয় সমগ্র প্রানী জগতের কল্যানের জন্য। আর এই নিয়মগুলোকে নৈতিক গুণাবলিও বলা যায়। এছাড়া আল্লাহ মানবজাতিকে নৈতিক প্রানি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন যার জন্য মানবজাতির নৈতিকতা মেনে চলা ফরজ বা আবশ্যক।

নিয়ম বা নৈতিকতার কারনে শিশু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পর্যায়ক্রমে সামাজিক আঙ্গিনায় ও রাষ্ট্রীয় আঙ্গিনায় আসে। প্রতিটি স্টেপে তাকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে অতিক্রম করতে হয়। এই নিয়মতান্ত্রিকতার মাঝে যখন শিশু তার কৈশোর ও যুবক অবস্থায় পৌঁছায় তখন সে মনে করে তার মত স্বাধীন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই, আর তখন হতে তার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যায়। যার ফলে এই জায়গাটা হতে নৈতিক মূল্যবোধহীনতার জন্ম হয়। যখন নৈতিক মূল্যবোধ হীনতা তৈরি হয়ে যায় তখন মানুষটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক বা না হোক তার কাছে নিয়ম মানার চেয়ে নিয়ম না মেনে অন্যের ক্ষতি করা, নিজের আধিপত্য বিস্তার করা, নিজেকে লাভবান করার ‘মোহে উম্মাদ’ হয়ে উঠে। আর তখন থেকে ব্যক্তির মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধগুলো না মেনে অনৈতিক ভাবে চলার প্রবনতা তৈরি হয় যা সে বাকি জীবন লালন ও ধারন করে। এভাবে একজন মানুষ নিজে, তার উত্তর শূরিরা ও তার সাথে সংশ্লিষ্টরা নৈতিক নিয়মগুলো না মানাতে অনৈতিক চলায় অভ্যস্ত হয়ে যায় যাকে বর্তমান সময়ের মহামারি ‘নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়’ বলা যায়।

‘মানুষের নিজেকে স্বাধীন মনে করাই’ নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারন বলে আমি মনে করছি। এছাড়া একবিংশ শতাব্দীর একুশ দশকে এসে বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা কি দেখছি বলেন তো? দেখছি ঘরে-বাহিরে ব্যক্তির মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা, ধর্ম না মানা, অজ্ঞতা, প্রযু্ক্তির অপব্যবহার, উন্মুক্ত সংস্কৃতির চর্চা, লোভ, স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নৈতিক মূল্যবোধ মাত্রাতিরিক্ত পরিমান কমে যাওয়া, নৈতিকতার চর্চা না হওয়ায়। বাংলাদেশের সর্বত্র (বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্কঠানে)কর্মকর্তা, কর্মচারী থেকে শুরু করে আমজনতাসহ সকল স্তরে, প্রায় সকল কাজে নৈতিক মূল্যবোধহীনতার রমরমা চর্চা। আমি হলফ করে বলতে পারি ২০২১ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রয়েছে সর্বনিন্ম পর্যায়ে যা শুরু হয়েছে বিংশ শতকের আশি- নব্বইয়ের দশক হতে। নৈতিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের ফলাফল কম বেশি সকলেই প্রতিনিয়ত পরখ করছেন তাই এটা নিয়ে বলছিনা। বলছি এই অবক্ষয় বাংলাদেশ তথা মানবজাতির জন্য কোন কল্যাণকর সংবাদ হতেই পারে না বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি আরোও বলতে চাই যদিও অনেকেই মনে করছেন বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তাদের ধারণা যথাযথ নয়। কারন বাঙ্গালাদেশীদের ‘নৈতিক মূল্যবোধ তলানিতে রেখে’ বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে যাবে এমন চিন্তাকে দিবালোকের স্বপ্নই বলা চলে বাস্তবতায় নয়। নৈতিকতা আল্লাহর নিয়ম যতক্ষণ নৈতিকতার মধ্যে মানুষ ফিরে না আসবে ততক্ষণ আল্লার সাহায্য করবে না, যতক্ষণ আল্লাহ সাহায্য না করবে ততক্ষণ কেউ উন্নত সমৃদ্ধ হতে পারবে না আর হলেও তা সাময়িক হবে স্থায়ী নয় এই বিশ্বাস মুসলমান হিসেবে সবার অন্তরে ধারন ও লালন করাও ফরজ।

আপনাদরকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই ইতিহাস বলে যখনই মানুষ বা জাতির মধ্যে নৈতিকতার চরম অধঃপতন ঘটেছে একটু সময় লাগলেও তার পতন অনিবার্য হয়েছে। কেননা মানুষ যখন আল্লাহর নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় দিন মাস বছর অনৈতিক ভাবে পার করতে থাকে তখন আল্লাহ তাকে দশ দিন ছাড় দিয়ে একদিনই ধরে। আর ঐ একদিনই তার পতনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায় ইতিহাসে এরকম অসংখ্য অগনিত উদাহরণ রয়েছে তার মধ্যে এরশাদ শিকদার, আহমেদ কবির, ইরফান,সুলতানা পারভিন, সাহেদ, সাবরিনা, আব্দুল মালেক, সামিয়া রহমান ও সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান (ঢাবির দুই শিক্ষক গবেষণা লেখা চুরির দায়ে বরখাস্ত) মত অসংখ্য ব্যক্তির পতন আপনারা দেখেছেন।

নৈতিকতা আল্লাহর নিয়ম সেই নিয়ম না মেনে অনৈতিকতায় লিপ্ত থাকলে ও মূল্যবোধহীন কাজ করলে তার পতন ঠেকানোর সাধ্য দুনিয়ার কারো কখনও হবে না। তাই সময় থাকতে থাকতে বাংলাদেশের মানুষকে নৈতিকতায় ফিরে যেতে হবে। নৈতিকতায় ফিরে যেতে মুখ্য ভূমিকা রাখবে রাষ্ট্র, আর নৈতিকতার মানদন্ডে থাকবে ইসলাম ধর্ম। আমার ক্ষুদ্র পর্যবেক্ষন বলে বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণির অনৈতিক কর্মকান্ড অশিক্ষিতদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। শিক্ষিত শ্রেনির অনৈতিক কাজগুলো অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও নিঁখুত তাই এরা ধরা ছোঁয়ার বাহিরে থাকে। আপচোছ এদের উচ্চ শিক্ষা এদেরকে আল্লাহর ভয় উপেক্ষা করে অনৈতিক কাজ কতটা নিখুঁত ভাবে করতে হয় সেটা শিখেছে বলে, ঘেন্না এদের শিক্ষাকে।

যাহোক আমার ঘেন্নায় এদের কিছু যাবে আসবে না জানি তাই বলছি যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ বা সবকিছুই রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তাই রাষ্ট্র মানুষকে নৈতিকতায় ফিরতে, মানতে, সকল কাজে নৈতিকতা চর্চা করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন ও তা কার্যকর করতে বিনীত অনুরোধ করছি। নৈতিক মুল্যবোধের অবক্ষয় বন্ধ করে নৈতিকতায় ফিরলেই উন্নত সমৃদ্ধ হওয়া যাবে অন্যথায় নয় আর হলেও তা হবে সাময়িক।

লেখক: ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী এবং এমফিল গবেষক