শিক্ষিত হলেও নৈতিকতাবোধ তৈরি হয় না

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২১

মারজাহান আক্তার: আমার দেশে শিক্ষিত বলতেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দ্বারা জ্ঞান অর্জন করা বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পড়াশোনা শেষ করাকে বুঝায়। যেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা উচ্চ শিক্ষা দিয়ে নৈতিক মূল্যবোধ বা বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি হয় না সেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না? আপনাদের কি মনে হয় প্রয়োজন আছে?

দেখুন একজন মানুষ দৈনিক পাঁচ বেলা পেট পুরিয়া খেতে পারে আপনি যদি তাকে এক বেলা সামান্য খাবার খেতে দেন তবে সে তা খেলেও এটা মনে করবে সে আজ কোন খাবারই খায় নি। কেন বলছি? বলছি এই জন্য যে শিক্ষা একটা দেশের সবচেয়ে বড় অমূল্য সম্পদ। পরিবারের মাধ্যমে মানুষকে সকল দিক থেকে শিক্ষিত উচ্চ শিক্ষিত করা যায় না বলে রাষ্ট্রীয় আঙ্গিনায় মানুষকে শিক্ষিত করতে একটি দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষিত উচ্চ শিক্ষিত হওয়ার পর সেখানে থেকে যদি পাঁচ বা আট বা দশ % মানুষ নৈতিক গুণাবলি বা বিবেকবোধ সম্পন্ন হয়ে বের হয় তাহলে কি সেই শিক্ষাকে খাবার খাইনির সাথে তুলনা করা যায় না?

অনার্স- মাস্টার্স পড়াকালীন সময়ে কারো উচ্চ পড়ার কথা বা উচ্চ পদে চাকরি করার কথা শুনলে মনে হতো আমি যদি হতে পারতাম বা উনি কতই না জ্ঞানী, কতই না ভালো মানুষ, কত বড় চাকরি করেন, তিনি কোন অন্যায় করেন না এরকম আরো কত ভালো কথা মনে চলে আসত। কিন্তু বাস্তব জীবন ও কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে এরকম কিছু না হওয়ার জন্য বলি আলহামদুলিল্লাহ। এরকম উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ চাকরির কথা শুনলে এখন শুধু ঘেন্না আসে তাই নয় সাথে সাথে মনে পড়ে যায় এদের অনৈতিক কাজ গুলোর কথা। ইরফান, দিহানের (আনুশকা হত্যায় যে বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়েছে) মত নাম না জানা হাজারো অপরাধীর চিত্র সামনে না আসা ও বর্তমান পরিস্থিতি এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলে স্বল্প সংখ্যক ভালো মানুষ ছাড়া বর্তমান সময়ে শিক্ষা, চাকরি, আর্থ-সামাজিক অবস্থা যার যত উপরে তার চরিত্র ও কর্ম ততটাই কলুষিত বা অনৈতিক যা অবশ্যই ঘেন্নার যোগ্য।

আমার মতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য দুটি ১. মানুষকে ভালো-মন্দের পার্থক্য শিখিয়ে তার বিবেকবোধকে বা নৈতিকতাবোধকে জাগ্রত করা ২. অর্থ উপার্জন করতে শিখা। দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্যি আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার অর্থ ‘অর্থ উপার্জন করা’ নৈতিক শিক্ষা নয় তার বড় প্রমান দেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা। তা না হলে কি আমাদের দেশের মানুষ প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পরিনত হয়েছে, হচ্ছে নৈতিকতাহীন ব্যক্তিতে? আপনাদের আমি মনে করিয়ে দিতে চাই ‘শিক্ষা সেই অর্জিত জ্ঞান যে জ্ঞান মানুষকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকতে ও ভালো কাজ করতে শেখিয়ে থাকে’। এছাড়াও আমি আরো মনে করি ভালো-মন্দ কাজ কোনগুলো তা বুঝার জন্য মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও কোন অসুবিধা নেই। কারন পরিবার সমাজে বাস করতে গিয়ে তা দেখে, ঠেকে, করেও শিখতে পারা যায় বলে। আমার কাছে আমাদের বর্তমান শিক্ষার অর্থ হলো ভালো চাকরি বা বেশি অর্থ উপার্জন করা ‘নৈতিক দিক না মানা’। পৃথিবীতে কেউ যখন মানুষ হয়ে আসে তখন নৈতিকতা মানা তার জন্য আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন যা না মানার কোন সুযোগই নেই। কিন্তু মানুষ সেই নৈতিকতা উপেক্ষা করে নিজের মত সারাক্ষণ অনৈতিক কাজ করেই চলছে যা আল্লাহ মানুষকে করতে নিষেধ করছেন। অথচ বর্তমানে বেশির ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতরা তা করছে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানেই মানুষের মধ্যে সুউচ্চ বিবেকবোধ, নৈতিকতাবোধ তৈরি হওয়া এমন ধারণা একেবারেই ভুল তা আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থাই প্রমান করে। আমাদের সমাজে প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে যত বেশি শিক্ষিত তার বিবেকবোধ ও নৈতিকতাবোধ ততও বেশি তাই সমাজের জন্য যেকোনো কাজে তাকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি মূল্যায়ন করা হয় এতে তার অহংকার বৃদ্ধি পেয়ে এক পর্যায়ে সে ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করে নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে পড়ে। বর্তমান সমাজ টা এমন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে যেখানে কেউ নৈতিকভাবে ভালো হলে তিনার কথা অন্যদের ভালো লাগে না। কেন? কারন বেশির ভাগ মানুষের কাছে এখন অনৈতিকতাই যে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে সে জন্য।

যারা অনৈতিকতাকে নিয়মে নিয়ে আসছে তারা যেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, যারা অনৈতিকতার কাজকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় মানতে বাধ্য হচ্ছে তারাও বেশির ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। গত একবছরে যতগুলো উল্লেখযোগ্য অপরাধ মিডিয়া কভারেজ হয়ে আসছে বেশির ভাগই উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা করেছেন যেটা আপনারা দেখেছেন। তারা স্বল্প সময়ের অপরাধী নয় এমনকি ধরা পড়ার আগেও পরে তা যাতে ব্যাপক মানুষ জানতে না পারে এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমানের চেষ্টা যে করে নি তা কিন্তু না বরং ঐ অপরাধের শাস্তি হতে মুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখে করে নেয় যাদেরকে দিয়ে করিয়ে নেই তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এমনও শোনা যায় চাকরিটাই এমন চাইলেও নৈতিকতা বজায় রাখা যায় না! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের দ্বারা নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক, সন্ত্রাস, অশ্লীলতা, ইভটিজিং, যেনা, ঘুষ, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কেলেংকারী, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ধর্ষণ, স্বজনপ্রীতি, বিকৃত রুচির কাজ ইত্যাদিসহ আরো নানা ধরনের অনৈতিক কাজ কোনটায় নাম নেই বলেন? সবটাতে আছে কিন্তু এমন নৈতিকতাহীন কাজ তো এদের দ্বারা হওয়ার কথা নয় হচ্ছে তো! যারা নিজেরা প্রতিহত করার কথা তারা নিজেরাই করছে, অনুগতদের চর্চা করাচ্ছে, অভ্যস্ত করে তুলেছে। নৈতিকতা বর্জিত এসব শিক্ষতরা দুর্জন, দুর্জন সর্ব অবস্থায় পরিত্যাজ্য তাহলে প্রমানিত হলো তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা নৈতিকতাবোধ তৈরি করতে পারেনি।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের অতিরিক্ত অপ্রয়োজনহীতার লোভ তাকে যখন শিক্ষিত সচ্চরিত্রহীন পশুতে পরিণত করে তখন শুধু অপরাধই করে না সেই অপরাধকে লুকাতে আরো বড় আপরাধ করে বিবেকবোধকে লোপ করে দেয়। দেশ পরিচালনার কাজে যারা নিয়োজিত আছেন তারা বেশির ভাগই কোন না কোন সমাজের জ্ঞানী ব্যক্তি। একবার ভেবে দেখুন জ্ঞানীদের দ্বারা যা হচ্ছে তা হওয়া উচিত ছিল কি? নিজেরা সচ্চরিত্রবান হবে, কর্মস্থলের পরিপূর্ণ সৎ থাকবে, মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা ও কাজ করবে ইত্যাদি। তিনাদের সকল কর্ম তাদের অনুগতদের জন্য হতো অনুকরনের দৃষ্টিান্ত যা হচ্ছে না। তথাকথিত এসব জ্ঞানীদের অনৈতিক কাজকে শিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বললেও ভুল হবে না। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানি শিক্ষার জ্ঞান অর্জনটা যদি নৈতিকতার সাথে অর্থ উপার্জন হতো তাহলে এই দুর্দিন দেশকে দেখতে হতো না কেন বলছি? এই জন্য বলছি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিতরা সমাজের জন্য কল্যাণময়ী না হয়ে সমাজের জন্য অভিশপ্ত হয়ে গেছে বলে।

একটু খেয়াল করলে আপনারা দেখতে পাবেন দেশ পরিচালনা ও দেশকে সছল রাখার কাজে কাজে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়োজিত তারা প্রায় সকলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত এসব মানুষ সমাজের ও রাষ্ট্রের সম্মানিত ব্যক্তি তাঁদেরকে সমাজের মানুষ শ্রদ্ধা করে, যৌক্তিক ভাবে বুঝাতে পারলে তাঁদের কথা সমাজের সবাই মানে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতের হার অনেক বেশি ভবিষ্যতে এই হার হয়ত আরো বাড়বে তাই আমি অনুরোধ করব আল্লাহর নির্দেশ মানা ও দেশ,জাতি সকলের কল্যাণের জন্য তাদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করে নিজে এবং অনুগতদেরকে সাথে নিয়ে নৈতিকতায় ফিরে আসতে। সময় লাগলেও দেশ তথা বাঙালীজাতির মধ্যে নৈতিকতাহীনতার যে জয়জয়কার ধ্বনি চলছে তা বন্ধ করে বা নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে আবারও নৈতিকতায় ফিরতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।

আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিরোধিতা করছি না, তবে মনে করছি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকবে থাকতে হবে সাথে নৈতিক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা গেলে দেশ, জাতি উন্নত ও সমৃদ্ধ হওয়ার পথে কোন অন্তরায় থাকবে না।

  • লেখক: ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী ও এমফিল গবেষক