বেসরকারি শিক্ষকদের বহুমুখী অপ্রাপ্তীর গল্প, পর্ব-২

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৭:৩৬ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৬, ২০২৩

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানান ভাগের-ভোগের শিক্ষক শ্রেণি রয়েছে। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি শিক্ষক, বেসরকারি শিক্ষক, এমপিওভূক্ত শিক্ষক, ননএমপিও শিক্ষকসহ নানান শ্রেনি-বর্ণ। সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রের রয়েছে নানান বৈষম্য। বিষেশ করে এমপিওভূক্ত বেসরকারি শিক্ষক এবং নন এমপিও শিক্ষকদের অবস্থা একেবারে তলানিতে আছে। ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে বেসরকারি শিক্ষকদের নানান শোষন বঞ্চনা নিয়ে ধারাবাহিক লেখার আজ দেখুন দ্বিতীয় পর্ব। লিখেছেন- সারোয়ার মিরন

হবু শিক্ষকদের আতংকের নাম এমপিওভূক্তির আবেদন:
সরকারি রীতি-নীতি মেনেই এনটিআরসিএ কিংবা কমিটি শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করে থাকেন। দেশের অন্যান্য সংস্থা-সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানও তেমনটা করে। নিয়োগ পাবার পরপরই কর্মস্থলে যোগদান করার পর বেতন-ভাতা পাওয়া তাঁর অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু একজন হবু শিক্ষককে তার বেতন-ভাতা অনুমোদন করাতে বারোঘাটের পানি খেতে হয়। প্রায় অর্ধশতাধিক ডক্যুমেন্ট সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে তা স্ক্যান এবং অনলাইনে ছয় পাতা বিশিষ্ট শতাধিক তথ্য পূরন করে সরকারি বেতন-ভাতা (এমপিও)র আবেদন করতে হয়। সেই আবেদন প্রতিষ্ঠান থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগে ৩/৪ সেকশন ঘুরে অবশেষে মন্ত্রনালয় তা চূড়ান্ত অনুমোদন করে। এ প্রক্রিয়ায় সময় লাগে প্রায় দু মাস। এমপিওভূক্তির এ আবেদনে প্রতি ঘাটের দুনীর্তি ও স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। সেটা প্রকাশিত। এ এমপিও আবেদনে আবার বিভিন্ন শর্ত রয়েছে প্রতি বিজোড় মাসের ১ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে আবেদন করতে হবে। কেউ যদি জোড় মাসে নিয়োগ পান তাকে অন্তত একমাস সময় অপেক্ষা করতে হয় আবেদনের জন্য। একজন সাধারন শিক্ষক হিসেবে আমার মাথায় ধরেনা যে প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়, সে প্রতিষ্ঠান কেন নিয়োগকৃত শিক্ষকের বেতন-ভাতার সুপারিশ করে দিতে পারেন না! এখানে জটিলতা আসলে কোন জায়গায়। গতো কয়েক মাস ধরে শুনে আসছি এমপিওভূক্তির আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করা হবে। সেটিও আলোর মুখ দেখছেনা। এমপিওভূক্তির এর জটিল প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের লোকও মন্তব্য করেছে এটি একটি ফাউল সিস্টেম। যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

অন্য জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মাঝে হতাশা!:
চাকুরীর মন্দা বাজারের প্রভাবে শিক্ষক হতে আগ্রহী নিবন্ধনধারীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় আবেদন করার সুযোগ পান। মেধাক্রম অনুসারে নিজ জেলার বাহিরে শিক্ষা—প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশও পেয়ে যান। অনেকটা বাধ্য হয়েই বাড়ি থেকে ৬/৭শ কিলোমিটার দুরে শিক্ষকতা আসেন তারা। এনটিআরসিএর মাধ্যমে সুপারিশ পেয়ে হাজার মাইল দুরে চাকুরী করাটা হতাশাজনকই। মাত্র ১২হাজার ৫শ টাকা বেতনে এত দুরে অবস্থান রীতিমত মানসিক নির্যাতন। দুরে চাকুরি করা শিক্ষকরা হতাশায় ভোগেন। একদিন না একদিন বদলী সিস্টেম চালু হবে সে আশায় প্রহর গোনেন। দুরে নিয়োগ পাওয়া অনেক শিক্ষকই আক্ষেপ করে বলেন, বছরে এক ঈদে বাড়ি যাওয়া হয়। পরিবার পরিজন রেখে এতো দুরে থাকতে কষ্ট হয়। আত্মীয়-স্বজন মারা গেলেও যাওয়ার সুযোগ হয় না। অল্প টাকা বেতন ভাতার কারনে পরিবারকেও নিয়ে আসতে পারছিনা। অন্যদিকে দুরের শিক্ষদের উপর স্থানীয় সহকমীর্ এবং স্থানীয়দের প্রভাববিস্তারের অভিযোগও রয়েছে। নারী শিক্ষকদের বেলায় এ দুভোর্গ আরো বেশি। সব মিলিয়ে তারা হতাশায় রয়েছেন।

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রধান বাধা অতিরিক্ত শ্রেনি শিক্ষার্থী:
বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত যোগ্যতা ও দক্ষতানির্ভর নতুন শিক্ষাক্রমকে বেশ বাস্তবসম্মত মনে করছেন শিক্ষকরা। কিন্তু এ যথাপোযুক্ত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে প্রধান সমস্যা দেখছেন শ্রেণি প্রতি অতিরিক্ত শিক্ষার্থীকে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেনিতে বাস্তবায়নাধীন এ নতুন শিক্ষাক্রম সাধারনত উন্নত দেশের আদলে সাজানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। প্রতি শ্রেনিতেই গড়ে শতাধিক শিক্ষার্থী পাঠ কার্যক্রমে উপস্থিত থাকে। এ বিশাল শিক্ষার্থীকে দক্ষতা ও যোগ্যতা ভিত্তিক কার্যক্রমে সমান ভাবে নিযুক্ত করা যায় না। একজন শিক্ষকের পক্ষে এতো বিশাল পরিমান শিক্ষার্থীকে পরিচালনা কিংবা মূল্যায়ন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাই প্রতি শ্রেনিতে ৪০জন শিক্ষার্থী রেখে প্রয়োজনে শাখা খুলে পর্যাপ্ত শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন সহজ হবে।

প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয়ে প্রধানরাই সর্বেসর্বা:
হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সকল আয়-ব্যয় কিংবা আর্থিক বিষয়াদিতে সাধারন শিক্ষকদের অংশগ্রহন নেই বললেই চলে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা সব সময়ই আর্থিক বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কৌশলে কিংবা চাপে রেখে সহকারি শিক্ষকদের দুরে রাখেন। এর অন্তরালের কারন হলো সীমাহীন দুর্নীতি। পরিচালনা কমিটিকে ম্যানেজ করে, স্থানীয় প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ভাবে কোনঠাসা করে রাখেন প্রধানরা। অনেক প্রধান আছেন জবাবদিহিতার ভয়ে কৌশলে মন মত কমিটি গঠন করেন, অস্থায়ী কমিটি করেন। সম্ভব হলে কমিটি না করেও নিজে স্বেচ্ছাচারিতায় বছরের পর বছর প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকেন। সরকার ও মন্ত্রনালয় কতৃর্ক অডিট কমিটি থাকলেও তা হতে সময় লাগে সাত-আট বছর। এ বছরের জুন মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীন অর্থ কমিটি গঠন করার নির্দেশনা প্রদান করলেও অনেক প্রধান এতেও ভ্রম্নক্ষেপ করছেন। কেউ কেউ আবার নামমাত্র সাজিয়েছেন।

অভ্যন্তরীন সুযোগ-সুবিধায় বৈষম্য:
সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মচারীগণকে অভ্যন্তরীন বেতন-ভাতা বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকলেও এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম যারা অভ্যন্তরীণ সুযোগ সুবিধায় শিক্ষক-কর্মচারীগণকে ঠকাচ্ছে। যথেষ্ট আয় এবং উল্লেখযোগ্য পরিমান ফান্ড থাকার পরেও নানান অজুহাতে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আবার অভ্যন্তরীণ বেতন-ভাতা নির্ধারনেও বৈষম্য করা হচ্ছে। প্রধানদের আস্থাভাজনদের জন্য একরকম এবং যাদেরকে অপছন্দ করেন তাদের জন্য ভিন্নরকম সিদ্ধান্ত। প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতির মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে বেতন-ভাতা বন্ধ করা বা চালু করা। এসব বৈষম্যে শিক্ষক-কর্মচারীগণের মধ্যে সবসময়ই একটা চাপা ক্ষোভ এবং গ্রুপিং লক্ষ্য করা যায়।

ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিভূক্তি না হওয়া:
বেসরকারি কলেজসমূহে ডিগ্রি কোর্স চালু থাকলে প্রতি বিষয়ের বিপরীতে তিনজন শিক্ষক থাকা আবশ্যক। এরমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক শাখায় একজন এবং ডিগ্রি শাখায় একজন শিক্ষক এমপিওভূক্ত হতে পারবেন! বাকি জন ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষক নামে পরিচিতি। তিনি এমপিওভূক্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। এ কেমন নিয়ম বলেন তো! একই যোগ্যতাসম্পন্ন একই নিয়ম-বিধিতে নিয়োগ হয়েও দুজন এমপিওভূক্ত হতে পারবেন বাকিজন হতে পারবেন না, এটা রীতিমত খামখেয়ালিপনার মতো বিষয়। অবশ্য গতো বছর থেকে এ সমস্যা দূরীকরনে কিছুটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাও আবার বিভিন্ন শর্তযুক্ত। এমপিওভূক্ত না হতে পেরে ডিগ্রিস্তরের তৃতীয় শিক্ষকদের যে ভোগান্তি এবং দুভোর্গ তা অবর্ননীয়। নিয়োগ দিয়ে বেতন দেয়া হবে না এটা অন্যায়। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান জরুরী।

 

বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও না হওয়া:
সারাদেশে জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে তিন শতাধিক বেসরকারি কলেজে ডিগ্রি কোর্সের পাশাপাশি অনার্স কোর্স খোলা রয়েছে। বেশ কিছু কলেজে অনার্স কোর্সের পাশাপাশি মাস্টার্স কোর্সও চালু রয়েছে। ১৯৯২সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বেসরকারি কলেজ সমূহে অনার্স কোর্স খোলার অনুমোদন দিয়ে আসছে। এ দুটি কোর্স পরিচালনার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য নিয়ম-কানুন রয়েছে। মোদ্দাকথা এসব স্তরের কর্তাব্যক্তি হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। একটি কলেজে অনার্স কোর্স চালু থাকলে প্রতি বিষয়য়ে ৭জন এবং মাস্টার্স কোর্স চালু থাকলে ১২জন শিক্ষক থাকার নিয়ম (উচ্চ মাধ্যমিকে ১, ডিগ্রিতে ২, অনার্সে ৪ এবং মাস্টার্স কোর্সে ৫জন)। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সারাদেশে অনার্স কোর্স পরিচালনাকারী তিনশতাধিক কলেজে প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক এমপিওভূক্ত হতে পারেন না। অদ্ভুদ দেখায় বিষয়টা। একই কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষকরা এমপিওভূক্ত হতে পারলে অনার্সের শিক্ষকদের বেলায় সমস্যা কোথায়। শিক্ষকদের অভিযোগ জনবল কাঠামোতে না থাকার অজুহাতে তাদের এমপিও দেয়া হচ্ছে না। সম যোগ্যতায় নিয়োগ পেয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রি পর্যায় এবং কামিল মাদ্রাসা পর্যায়ে এমপিওভূক্ত হতে পারলে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিও দেয়া যাবে না কোন কারনে! ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি বেতন-ভাতা না পেয়ে এ স্তরের শিক্ষকদের দিন কাটছে চরম মানবেতর। সমাজ ও নিজ কর্মস্থলে নানান মানসিক নিপিড়নের শিকার হচ্ছেন তারা। বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনা করে দ্রুত একটা সুরাহা করবেন এমনটাই যথাযথ কতৃর্পক্ষের নিকট প্রত্যাশা করছি।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: জাতীয় শিক্ষক দিবস: বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের হতাশার গল্প

চলবে….

 

লেখক, সম্পাদক ও প্রকাশক

দেশালোক ডটকম