বিডিআর বিদ্রোহে শহিদ নুরুল ইসলামের লাশ মেলে ৭দিন পর: স্বজনরা চান রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১:৩৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৫

সারোয়ার মিরন:
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারীতে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের দিন হাজারো জওয়ান যখন গন্ডগোলের পক্ষে, তাঁরা খুঁজে খুঁজে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করছেন নৃশংসভাবে। ওই অবস্থায় কোনো কোনো বিডিআর সদস্য হয়তো এ হত্যাকান্ডের সমর্থন করেন নি, কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদও করেননি। তার মধ্যে ও একজন ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি হলেন বিডিআর এর তৎকালীন কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম। তিনি এ হত্যাকান্ডের প্রতিরোধ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরের মর্যাদা দিয়েছে।

শহীদ মেজর নুরুল ইসলাম এর ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান জানান, পিলখানায় দরবারে যোগ দিতে দেরি হয়ে যাবে- এই আশঙ্কায় বাবা সকালে নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়ে যান। বিদ্রোহের ঠিক ৭ দিন পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করি। এই দিনগুলোতে এমন কোন হসপিটাল নেই যেখানে বাবাকে আমরা খুঁজিনি। যে যেখানে বলেছে সেখানেই আমরা গিয়েছে। নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম আরও বলেন, বিডিআর পিলখানা হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহত অন্যান্যদের মত বাবার লাশও গণকবর থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়। পরে ঐ বছরের ৪মার্চ তার মৃতদেহ আমরা সনাক্ত করি।

তিনি জানান, দরবার হলে জওয়ানেরা হত্যাকান্ডের শুরু করার পর অনেকে যেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিলেন, সেখানে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে। হত্যাকান্ডের বাধা দেওয়ায় হত্যাকারীরা মশারির লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে আঘাত করার পর ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে।

জানা যায়, বিডিআর সদর দপ্তরে কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর হিসেবে তিনি ছিলেন বিডিআর এর প্রতিনিধি। মহাপরিচালকের সাঙ্গে তাঁর ছিল সরাসরি দাপ্তরিক সম্পর্ক। সেদিন ঘটনার শুরুর মুহুর্তে মহাপরিচালকের নির্দেশে তিনি মাইকযোগে জওয়ানদের শান্ত হতে বারবার অনুরোধ জানান, এগিয়ে যান সশস্ত্র জওয়ানদের প্রতিরোধ করতে। হত্যাকান্ডে বাধা দেওয়ায় পরে ৪জন বিডিআর সদস্য তার কাছ থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে তাকে লোহার স্ট্যান্ড দিয়ে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে। পরে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে মৃতদেহ গণকবরে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে আসে নুরুল ইসলামের এসব বীরত্বের কথা। এ হত্যাকান্ডের ছয় মাস পর একমাত্র বিডিআর সদস্য কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা পান এবং পরবর্তিতে সাহসিকতার জন্য বিজিবির সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পদকে ভূষিত করা হয় তাঁকে।

কর্মজীবনে তিনি ৪বার ডিজি পদক পেয়েছেন এবং অসাধারন কৃতিত্বের জন্য সরকার তাঁকে পবিত্র হজ্জ্ব পালন করান। নুরুল ইসলাম চাকরিজীবনে একজন সৎ মানুষ হিসেবে সবার শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। এছাড়াও তিনি শ্রেষ্ঠ বিওপি কমান্ডার ও শ্রেষ্ঠ কোম্পানি কমান্ডার এর স্বীকৃতি লাভ করেন। চোরাচালান রোধে তিনি পেয়েছেন বিশেষ পুরস্কার। রাইফেলস ট্রেনিং সেন্টারে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ ৮বছর। ২০০১ সালে পাদুয়া যুদ্ধে সংগ্রাম ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার ছিলেন নুরুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, সেদিন দরবার হলসহ পিলখানায় ৯হাজার এর অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিল। সারাদেশে ৫০ হাজারের অধিক বিডিআর সদস্য উপস্থিত খাকলেও কেউই এ হত্যাকান্ড এবং ১২০এর অধিক আফিসারদের জীবন রক্ষার্থে একমাত্র শহীদ নুরুল ইসলামই ভূমিকা রেখেছেন।
আশরাফুল আলম হান্নান তাঁর বাবার বহুমুখী বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে বীরত্বসূচক রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের মাধ্যমে সম্মানীত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনে রাষ্ট্রের প্রতি আবেদন জানান। পাশাপাশি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার কুশীলব এবং প্রকৃত হত্যাকারী ও অপরাধীদের বিচারের বাস্তবায়ন করা, শহীদদের মূল্যায়ন ও পরিবারকে সম্মান প্রদানের দাবি জানান। পাশাপাশি ২৫ফেব্রুয়ারিকে শহিদ সেনা দিবস ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

শহীদ কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলাম লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরগাজী ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মৃত লুৎফল করিম। পরিবারে তিনি স্ত্রী, তিন কন্যা ও এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন। গ্রামের বাড়িতেই তার লাশ সমাহিত করা হয়।