পদ্মাসেতুর অমিত সম্ভাবনা

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৫:১৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৭, ২০২০

সায়েম মাহমুদ: নানান জল্পনা কল্পনার পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরস্রোত নদী পদ্মাসেতু জয় করল বাংলাদেশ – ১০ ডিসেম্বর ২০২০ সব কটি স্প্যান বসানোর কাজ শেষ করার মাধ্যমে এক অনন্য ইতিহাস গড়ল রবী ঠাকুরের সোনার বাংলা। এখন সময় শুধু যান চলাচল শুরুর – আশা করা যাচ্ছে ২০২২ সালের ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে এর শুভ উদ্বোধন করা হবে ঘটা করেই। করবেই বা না কেন- এই একটি সেতু যেমনি বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে তেমনি বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জেদি ও দূরদর্শিতায় দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে সে কথা বিশ্ববাসীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিবে এই একটি সেতু। পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হলে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এবং অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় তিন কোটি মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসবে। বিশ্বব্যাংকের এ-বিষয়ক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ বা কমপক্ষে তিন কোটি মানুষ সরাসরি এ সেতুর মাধ্যমে উপকৃত হবে। এ সেতুর মাধ্যমে আঞ্চলিক বাণিজ্য সমৃদ্ধ হবে, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন হবে এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশের ওই অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকার দূরত্ব গড়ে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত কমবে। কমবে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের সময় ও অর্থ।

১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর উদ্বোধন করা হয়। সে-সময়েই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সুবিধার জন্য পদ্মায় সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৯৮ থেকে ২০০০—এ সময়ে পূর্বসম্ভাব্যতা যাচাই শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে জাপানিদের সহায়তায় সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। ২০০৪ সালের জুলাইয়ে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার সুপারিশ মেনে মাওয়া-জাজিরার মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শ প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করে। মহাজোট সরকার শপথ নিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু করার চূড়ান্ত নকশা করা হয়। নতুন নকশায় নিচে চলবে রেল এবং উপরে মোটরগাড়ি। এতে অর্থায়নের কথা ছিল এডিবি, জাইকা ও বিশ্বব্যাংকের। কিন্তু দুর্নীতির ধুয়া তুলে একে একে সবাই অর্থায়ন থেকে ফিরে যায়। তবে দমেনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন সরকার। ২০১৩ সালের ৪ মে নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা আর প্রবল উন্নয়ন মানসিকতার ফলেই সম্ভব হয়েছে পদ্মা সেতুর উন্নয়নকাজ এগিয়ে নেয়া। বিশ্বমোড়লদের তিরস্কার আর অবজ্ঞা করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ দেয়া সম্ভব হয়েছে এ স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমেই। সব ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। বিশ্বমাঝে এটা প্রমাণিত—আমরা পারি, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।

মাওয়া-জাজিরায় নির্মাণাধীন গৌরবের পদ্মা সেতু ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে আকাশমুখে। জানান দিচ্ছে বাংলাদেশের স্বকীয়তা, তুলে ধরছে স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন অবকাঠামোয় বাংলাদেশের সক্ষমতার স্বরূপ। স্বপ্ন বাস্তবায়নে এদেশের মানুষের সংগ্রামের ও একাগ্রতার পরিচয়। নিজেদের এ স্বপ্ন যেন শিগগির পূরণ হওয়া চাই। কারণ এর সঙ্গেই যুক্ত আগামীর রূপান্তরিত বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বর্ণময় ভবিষ্যত্। এ সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের প্রথম কোনো সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সেতু নির্মাণ হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন পাল্টে যাবে। উন্নয়ন ঘটবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষিরও। এ সেতু হয়ে গেলে তাদের কৃষিপণ্য খুব সহজেই ঢাকায় চলে আসবে। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে, যার ধনাত্মক প্রভাব পড়বে পুরো দেশের অর্থনীতিতেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পর্যালোচনা বলছে, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে। বর্তমানে প্রবৃদ্ধি আছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পদ্মা সেতু চালু হলে বাড়বে আরো ২ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে উন্নীত হবে।

 

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সমাপ্ত হলে জাতীয় জীবনে উপর্যুক্ত ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটবে। তাছাড়া বিনিয়োগে সঞ্চারিত হবে নতুন গতি। কোনো বিনিয়োগের ১২ শতাংশ রেট অব রিটার্ন হলে সেটি আদর্শ বিবেচনা করা হয়। এ সেতু হলে বছরে বিনিয়োগের ১৯ শতাংশ করে উঠে আসবে। কৃষি-শিল্প-অর্থনীতি-শিক্ষা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই এ সেতুর বিশাল ভূমিকা থাকবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু কেবল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। আরো বিশদভাবে বলতে গেলে, এ সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বাণিজ্য, পর্যটনসহ অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে এ সেতু আসলেই দেশের মানুষের স্বপ্নের সেতু হয়ে উঠবে।

পদ্মা সেতুকে ঘিরে এর দুই পাড়ে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই নগরের আদলে শহর গড়ে তোলার কথাবার্তা হচ্ছে। নদীর দুই তীরে আসলেই আধুনিক নগর গড়ে তোলা সম্ভব। তবে সেজন্য এখনই পরিকল্পনা নিতে হবে। এ সেতু ঘিরে কী কী হতে পারে, কোথায় শিল্প-কারখানা হবে, কোথায় কৃষিজমি হবে সেসব এখনই বিবেচনা করা উচিত। প্রয়োজনে এখানে প্রশাসনিক রাজধানী হতে পারে। এ সেতুকে ঘিরে পর্যটনে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। অনেক আধুনিক মানের হোটেল-রিসোর্ট গড়ে উঠবে। এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ২০৩৫-৪০ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সেক্ষেত্রেও এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এ সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ।

এ সেতুর মাধ্যমে শিল্পায়ন ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড প্রসারের লক্ষ্যে পুঁজির প্রবাহ বাড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্থানীয় জনগণ উন্নততর স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য খুব সহজেই রাজধানী ঢাকা যেতে পারবে। নদীর তীর সংরক্ষণের ফলে নদীভাঙন ও ভূমিক্ষয় কমবে। আর সেতুর নির্মাণকাজ চলাকালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের কর্মসংস্থান হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতে, এ সেতুর ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ ও আঞ্চলিক জিডিপি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।

smkiiuc@gmail.com