বাবা’র জীবনের শেষ সময়

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৫:১৩ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০২১
সারোয়ার মিরন:
২০১৯ সালের অক্টেবর থেকে ডিসেম্বরের ২২তারিখ পর্যন্ত বাবাকে নিয়ে ঢাকায় ছিলাম। সময়ের হিসেবে প্রায় দু মাস। নতুন জব (শিক্ষকতা) বেতন পাচ্ছিনা। কয়েকদিন ধরে বাবা অসুস্থ। কর্মস্থল (আলআমিন ফ্যাক্টরি) মাইজদি থেকে বাড়িতে এলেন। নোয়াখালীতে একাধিক ডাক্তার দেখালাম। চিকিৎসা চলছে। উন্নতি হচ্ছে না দেখে প্রাইমে দেখালাম। দু বার সিটিস্ক্যান করালাম। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার ঢাকায় নিউরোসাইন্স হাসপাতালে রেফার করলেন।
দু তিন দিন পরেই এক মধ্যরাতে বাবাকে নিয়ে ছুটলাম ঢাকার পথে। এ্যাম্বুলেন্স ছুটছে। নির্বাক বাবা শুয়ে আছেন এ্যাম্বুলেন্সের বেডে। অসহায় মুখে আমরা তিনজন বাবার সাথে। আমি, ভগ্নিপতি বেলাল আর আমার মা। ভোর চারটায় পৌছলাম নিউরোসাইন্সে। সিরিয়াল প্রথম দিকে পেলাম। কারন চারটা থেকেই লাইন ধরলাম। ডাক্তার দেখলেন এগারোটায়। পুর্বের রিপোর্ট এবং রোগির অবস্থা দেখে এমআরআইসহ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিলেন। ছোট পরীক্ষা নিরিক্ষা গুলো নিউরোসাইন্সে করানো গেলেও এমআরআই করাতে দু মাস লাগবে। মানে সিরিয়াল নেই। আয়েশা মেমোরিয়ালে গেলাম। সেখানে করালাম এমআরআই। নিউরো বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তারও দেখালাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাবাকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লাম। রাতে রোগিসহ চারজন মানুষ কোথায় থাকবো সে চিন্তা মাথায়। মহাখালীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুঁজলাম। হোটেলে রোগিসহ কেউ থাকতে দিবেনা।
রাত আটটা। সারাদিন ধরে সময় দেয়া বন্ধু রাব্বানী বিদায় নিল। অনেক চিন্তা করে বোনের এক বান্ধবীকে ফোন করলাম। ওর বাসায় গেলাম রাত দশটায়। পাঁচ তলায় বাসা ওদের। আগের রাত ঘুম মারা। সারাদিন দোড়াদৌড়ি। ক্লান্ত শরীরে অসাড় শরীরের বাবাকে নিয়ে ওখানে উঠলাম।
দ্বিতীয়দিন সকালে আবার বাবাকে নিয়ে নিউরো সাইন্সে। রিপোর্ট দেখালাম। সিট না থাকার অজুহাতে ঢাকা মেডিকেলের নিউরো বিভাগে রেফার করলেন। ডাক্তার বলছেন মাল্টিপল ব্রেইন টিউমার (একাধিক টিউমার)। অনেক অননুয় বিনয় করেছি একটা সিটের জন্য! দালাল ধরেছি! টাকা অফার করেছি। বেশ কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেছি। সিট পাওয়া সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে এদিক সে দিক করতে করতে মোটামুটি সারাদিন শেষ।
বোনের বান্ধবীর বাসায় যাওয়া যাবেনা। পাঁচতলায় উঠানামা সম্ভব নয়। অগত্যা যোগাযোগ করলাম জাহের ভাইয়ের সাথে (এলাকার ভাই)। তাঁর বাসা যমুনা ফিউচার পার্কের ওদিক। উপায়ান্তর না দেখে ছুটলাম তাঁর দুই বেড এক কিচেনের বাসায়।দুপুরে পৌছলাম।
ভাবি বাসায় নেই। দুপুরের খাবার হয়নি। আমি আর জাহের ভাই হোটেলে খেলাম। বাসার জন্য পার্সেল নিলেন উনি। বিকেলে বাজার করলেন। রাতে মা রান্না করলেন। পরদিন সকালে আমি আবার নিউরো সাইন্সে। সারাদিন ধরে বহু কাটখড় পুড়িয়েও ব্যর্থ হলাম। পাঁচদিন ছিলাম জাহের ভাইয়ের বাসায়। চারদিনই ভাবি আমাদের জন্য কষ্ট করেছেন। আমরা বাসায় আসার খবর পেয়ে বোনের বাসা থেকে চলে এসেছেন।
এ পাঁচদিনে রিপোর্ট, ডাক্তার, নিউরো সাইন্স করে করে কাটিয়েছি। বাবা বিছানায়। একপাশ অসাড়। বিছানায় সবকিছু করেন। টুকটাক খাওয়া দাওয়া করেন। শেষ মেষ বাবাকে নিয়ে গেলাম ঢাকা মেডিকেলে। পুরাতন বিল্ডিংয়ের শহীদ মিনার গেটে সিরিয়াল নিয়ে ডাক্তার দেখালাম রিপোর্টসহ। উল্লেখ্য, সিরিয়াল টোকেন নেয়া লাগে এক।জায়গায়, ডাক্তার বসেন অন্য জায়গায়। বেশ কয়েকটি বিভাগ এক ফ্লোরে। মানুষ আর মানুষ। রোগি আর রোগি। দিন প্রায় শেষ।
ডাক্তার ভর্তি দিলেন। ঠিকানা ২০০নং ওয়ার্ড। সিট না পাওয়ায় বারান্দায় (চৌমুখী যাতায়াত গলি) ফ্লোরিং। সকাল বিকাল ডাক্তার দেখছেন। ঔষুধ চলছে। এভাবে তিন দিন কাটলো। মা, বাবার পাশেই ঘুমান। ভগ্নিপতি অন্যত্র সিড়িঁতে। আর আমি ফার্মগেটে বন্ধু ফিরোজের ম্যাসে। রাত দশটায় যাই সকাল সাড়ে নয়টায় আসি। ঢাকা মেডিকেলের জুরুরি বিভাগের গেট থেকে শাহবাগ হেঁটে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট লোকাল বাসে যাতায়াত। দু দিন জ্যাম থাকায় শাহবাগ থেকে ফার্মগেট হেঁটেও যাওয়া হয়েছে।
আজ এ ডাক্তার নাই তো কাল ও ডাক্তার নেই। এভাবেই কাটতে থাকলো। বিভাগ থেকে জানানো হলো আব্বার মাথায় অপারেশন করে টিউমার অপসারন করা হবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। এলাকার একজনের পরামর্শে রিপোর্ট নিয়ে দেখা করলাম রামগতির কৃতি সন্তান ডাঃ রেদোয়ান উল্যাহর সাথে। বাবার বয়স বিবেচনায় অপারেশন করাতে না করলেন। আলাপ করলাম বন্ধু ডাক্তার রুবেল চন্দ্র কুরীর সাথে। দু তিন ধরে অনেকের সাথে সলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম অপারেশন করাবো। যদিও কেউই জটিল অপারেশন করানোতে যুক্তি নির্ভর না করেছেন। তারপরেও আমি রাজি হলাম।
–চলবে
লেথক: সম্পাদক, দেশালোক ডটকম