একজন উপকূল মায়ের অসহায়ত্ব

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৬:১৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২১

আশরাফ আলী: মেঘনার তীরে বেড়াতে এসে পুরোনো বন্ধুদের সাক্ষাতে আনন্দে মতোয়ারা সকলে। ২০১০ সালের এসএসসি ব্যাচের বন্ধুরা মিলে স্মৃতি মাখা দিন গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ঈদ মৌসুম হওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুরা নাড়ীর টানে বাড়ি আসলেও সহপাঠীদের সাথে আড্ডা দেয়া ছাড়া যেন ঈদ আনন্দ জমেই উঠেনা। প্রতি বছর ঈদ উৎসবে একত্রিত হওয়া যেন রুটিন হয়ে গেছে।

তেমনি একটি মুহুর্তে স্মৃতি মন্থনে ব্যস্ত বন্ধুদের কেউ একজন বলে উঠলো ‘চল মেঘনার পাড় থেকে ঘুরে আসি’। তখন সময় বিকেল বেলা। পথের দূরত্ব কম হওয়ায় পায়ে হেঁটেই চললাম আলেকজান্ডার সংলগ্ন বিশ্বাল বিস্তৃর্র্ন উপকূলের আনন্দঘন পরিবেশের একটু ছোঁয়া নিতে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই পৌঁছলাম ৩১শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের সামনে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে বলাবলি শুরু হল- সত্যিই আমাদের রামগতি মেঘনা বীচ’ দেশের সব পর্যটন স্পটকে হার মানাবে। যদি এই স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষিত হতো!

শোঁ শোঁ বাতাস আর নদীর উত্তাল তরঙ্গের উপর শেষ বিকেলের সূর্যের চিক-চিক আলোর সমন্বয়ে পুরো নদীটি পানির পোয়ারা রূপে আবির্ভূত হয়েছে। পর্যটকদের পদভারে মুখরিত কোলাহলপূর্ন পরিবেশে হাতে হাত ধরে হেঁটে চলছি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন চোখ চেপে ধরেছে। সন্দেহ নিয়ে কয়েক জনের নাম বলার পর চোখ ছেড়ে দিয়ে সামনে হাজির নোয়াখালীর ৪ বন্ধু!

-কিরে তোরা এখানে!

-আমরা অনেক আগ থেকেই প্ল্যান করে রেখেছি। ঈদ উপলক্ষ্যে রামগতি ‘মেঘনা বীচ’ দেখতে আসবো। আসলে তোদের এখানে চমৎকার একটি দৃশ্য!

নোয়াখালীর বন্ধুরা মিলে হাসি-ঠাট্টায় নদী তীরের ভাজা টাটকা ভূট্টার খৈ খেতে খেতে এগিয়ে চললাম সম্মূখ পানে। দেখা হতে লাগলো জীবনে বাঁকে বাঁকে ফেলে আসা অনেক বন্ধুদের সাথে। তাদের মনের অজান্তেই বলে পেললাম আমার দেখা সর্বোচ্চ বিনোদন স্পট তৈরি করে দিয়েছে রাক্ষুসে মেঘনা। স্থানীয় বন্ধুরা বললো দোস্ত এখানে মূল স্পট নয়, আরো সামনে। অবাক হয়ে সামনে চললাম। কিছু দুর এগিয়ে আদালত ভবনের সামনে বিশ্বাল বিস্তৃর্ন নদী উপকূল দৃষ্টিগোছর হওয়ায় হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। দেখলাম বৌ-বাচ্চা নিয়ে অনেকে নদীর কূলে বেড়াতে এসেছে।

মানুষের প্রচন্ড ভীড়।এদিক- সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে উৎসুক জনতা। কেউ-বা আবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাদুর পেতে বসে চিনা বাদাম টিপছে। অন্যদিকে ভ্রমন পিপাসুরা স্পিড বোটে করে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নৌ-ভ্রমনের মহোৎসব দেখছে।

এর মাঝে দৃষ্টি গিয়ে ঠেকলো এক বুড়ি মায়ের করুণ চাহনীর দিকে। এর মাঝে দৃষ্টি ঠেকলো এক বুড়ি মা’য়ের দিকে। মেঘনার জল রাশি যেন ঢেউ খেলছে তার চোখের কোনে। অসহনীয় কষ্টের বর্ননায় দম পাটানো উল্লাস মুহুর্তের মধ্যে অমানিশায় নিমর্জিত হলো। সবার দৃষ্টি থেকে তার সম্পূর্ন আলাদা। মেঘনার জল রাশি তাঁর চোখে চল-চল করছে। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার কি হয়েছে? কি সমস্য? প্রশ্ন করতেই বেরিয়ে এলো বুড়ি মা’য়ের বিস্বাদময় জীবনের বর্ননা!

তিনি বললেন- “বাপু! জীবনের ৫২টি বছর অতিবাহিত করে শেষ জীবনে পোঁহাতে হচ্ছে অবর্ননীয় দশা। আমাদের বাড়িটি ছিল সেবাগ্রাম বাজারের ঠিক দক্ষিন পার্শ্বে। বিশাল পুরানো বাড়ী। ক্বারী সাহেবের বাড়ী বললে এক নামে সবাই চিনতো।

ভোর বেলায় পাখিদের কিচির-মিচির আর বিকেল বেলায় দক্ষিনা বাতাসে মন জুড়ায়ে যেত। বাড়ীর দরজায় খড়ের গাদার কাছে বাচ্চাদের আনন্দ হৈ-হোল্লোড়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। বাড়ির মহিলারা এক সাথে মাথায় শিতে দিতাম আর আড্ডায় মেতে উঠতাম। আমার স্বামী ছিলো একজন কৃষক। দীর্ঘদিন যক্ষা রোগে ভোগার পর দু’টি সন্তান রেখে মারা যান। এক বছরের মাথায় রাক্ষুসে মেঘনার ভয়ানক ছোঁবলে ভেঙ্গে যায় বসত ভিটে। হারিয়ে যায় প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কের বাঁধন। হারিয়ে যায় ছেলে মেয়েদের খেলার সাথী। একেকজন একেক জায়গায় মাথা গুঁজাবার জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।

এক ছেলে এক মেয়েসহ আমার ঠাঁই হয় মৌলভী কাঁন্দী বাবার বাড়ীর তিন বিঘা উত্তরাধীকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তিতে। বিয়ের উপযুক্ত হওয়ায় মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে পেলেছি। একমাত্র কর্মক্ষম ছেলেটিকে জেলেদের সাথে মাছ ধরতে পাঠালে জনৈক ডাকাতের বাহিনী ছেলেটিকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়!

তিন বছরের ব্যবধানে বাবার বাড়িও ভেঙ্গে যায়। তারপর থেকে রাস্তার কিনারায় সুখে-দুখে দিনাতিপাত করছি। এখন দেখি এ রাস্তাটিও ভেঙ্গে যাচ্ছে।

তাই তোমাদের আনন্দের মাঝে পূরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। বুকের মাঝে চাপিয়ে রাখা ব্যাথা আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই শত মানুষের বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে আমি একা কাঁদছি। “চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। কোন রকম সান্ত¡না দিয়েই কেটে পড়লাম।

 

লেখকরামগতি উপজেলার নাগরিক