চুল পেকেছে, দাঁত পড়েছে- রামগতিতে এতো পানি কখনোই দেখিনি

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১১:২৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২৪

সারোয়ার মিরন:
“৭৫ বছর বয়সের জীবনে কখনো আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে হয়নি, অনেক বন্যা দেখেছি! চুল পেকেছে, দাঁত পড়েছে, কানেও কম শুনি, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। জীবনের এ শেষ বয়সে আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে বাধ্য হয়েছি। ছেলে-মেয়ে, বউ মিলে অনেক কষ্টে নিয়ে আসছে এখানে।- খুব কাতর কন্ঠে কথাগুলো বলছেন লক্ষ্মীপুরে রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের বাসিন্দা আলেয়া বেগম। তিনি বন্যা কবলিত হয়ে তিনদিন হলো আশ্রয় নিয়েছেন পশ্চিম চর পোড়াগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয়টি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস।

২৫ আগস্ট রবিবার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: রেজাউল হক চৌধুরী জানান, এ বিদ্যালয়ের তিনটি ভবন রয়েছে। সবকটি ভবনে অর্ধ শতাধিক পরিবারের প্রায় দুই শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। নিয়ম করে প্রতিদিন তাদের দেখভাল করছেন তিনি। নিজের পারিবারিক উদ্যোগেও আশ্রিতদের সহযোগিতা করছেন। বিদ্যালয়ের প্রধান ভবনের নিচতলা খালি হওয়ায় সেখানে গবাদি পশু-পাখি রাখা হয়েছে। তিনি আরো জানান, বন্যা কবলিত এসব পরিবারের সদস্যরা দিনের বেলা বাড়ি-ঘর পাহারা দিচ্ছেন, আর সন্ধ্যায় ফিরে এখানে রাত্রি যাপন করছেন। অনেক কষ্ট করে এখানে দিন যাপন করছেন এসব অসহায় মানুষ। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সংগঠন সামান্য কিছু সহায়তা করে গেছেন। গতকাল শনিবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহি অফিসারের নেতৃত্বে এ আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন করে ত্রান সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। প্রধান শিক্ষক আরো জানান, এখানে বেশ কয়েকজন বয়ষ্ক, অসুস্থ নারী ও পুরুষ আছেন। যাদের খুব কষ্ট হয়।

চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের হাজীগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশের এনআরডিএস অফিস সংলগ্ন একটি বাড়ির দরজায় গিয়ে দেখা গেছে- পুরো এলাকার বাড়ি-ঘর, পথ-ঘাট ডুবে যাওয়ায় ড্রাম দিয়ে ভেলা তৈরি করা হয়েছে। সেই ভেলা চালাতে বাড়ি থেকে প্রধান সড়ক পর্যন্ত বিশাল রশি টানিয়ে রাখা হয়েছে। এ রশি ও ভেলা দিয়ে অনেক কষ্ট করে বাড়ির অসুস্থ এবং বয়ষ্কদের আনা-নেওয়া করা হয়। পাশাপাশি পানি প্রবেশ করায় গত এক সপ্তাহ ধরে বন্ধ রয়েছে এনআরডিএস অফিসটিও।

একই ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকায় ভূলুয়া নদী পাড়ের শাহ আলম, নাজিম উদ্দিন, আবদুর রহিমসহ বেশ কয়েকজন জানান, একমাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্ধী অবস্থায় রয়েছেন। তার বাড়ির দরজায় থাকা মসজিদে জুমা’র নামাজসহ ওয়াক্তিয়া নামাজগুলোও আদায় করা যাচ্ছে না। তারা আরো জানান, ত্রান দেওয়া কর্মী কিংবা প্রশাশনের কেউই প্রধান প্রধান সড়ক থেকে ভেতরের এলাকাগুলোতে প্রবেশ করছেন না। এ কারনে বহু পরিবার সরকারি-বেসরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

চর রমিজ ইউনিয়নের চর গোঁসাই এলাকার শিক্ষক নাজিম উদ্দীন জানান, চারিদিকে বৃষ্টির পানির পাশাপাশি জোয়ারের পানি থাকায় বিষধর সাপ ও পোকামাকড় আক্রান্তের শংকা রয়েছে। ইতিমধ্যে গতকাল বিকেলে আমরা একটি বিষধর সাপ মেরেছি।চর বাদাম এলাকার শাহেদা বেগম, বিবি মরিয়ম, মো: শরীফসহ অনেকে জানান, অনেকেই আসেন, ছবি তোলেন। সামান্য কিছু সহায়তা করেন। এটা দিয়ে একদিনও কাটে না। পরিবার পরিজন নিয়ে চিন্তায় আছে। হাজীগঞ্জের পশ্চিমে কোডেক এলাকায় বেড়ীবাঁধের ঢালে কুঁড়েঘরে বসবাসকারী শাহাবুদ্দিনের পরিবার জানান, গত এক সাপ্তাহ ধরে ঘরের চুলোয় আগুন জ্বলছে না। অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে ছয় সদস্যের পরিবারের।
এদিকে গতো এক সাপ্তাহ ধরে বন্যার পানি স্থিতিশীল রয়েছে। পানি প্রবাহের প্রধানতম নদী ভূলুয়াতে বাঁধ, দুপাশ থেকে দখল এবং জাল বসানোয় পানি যেতে পারছে না। এছাড়াও দৈনিক দুইবার জোয়ারের চাপে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। উপজেলার চরগাজী, চর রমিজ, চর আলগী, চর পোড়াগাছা, চর বাদাম, চর আলেকজান্ডার ইউনিয়নের প্রায় ৫০হাজার মানুষ পানিবন্ধী অবস্থায় রয়েছে। নষ্ট হয়েছে ৭শ হেক্টর আমন বীজতলা, ১হাজার ২শ হেক্টর রোপা আমন। ভেসে গেছে মাছের পুকুর, ঘের ও প্রজেক্ট। বেড়েছে মেঘনার ভাংগন।  বেশ কয়েকটি সেতুতে দেখা দিয়েছে ধস।

বাড়ির উঠানে বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলার চর আলগী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড চর নেয়ামত গ্রামে মো: মামুনের মেয়ে বিবি আয়েশা (৩) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনা ঘটে। বন্যায় আক্রান্ত এসব পরিবারের সদস্যদের অত্যন্ত মানবেতর দিন কাটছে। পর্যাপ্ত ত্রান সহায়তা না পাওয়ায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটছে।

উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার কার্যালয়সূত্রে জানা যায়, বন্যা দুর্গতদের জন্য উপজেলায় ৪৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর বাহিরেও অস্থায়ীভাবে বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এসব আশ্রয় কেন্দ্রসমূহে দুই সহস্রাধিক বন্যাদুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তার নেতৃত্বে আশ্রয়কেন্দ্রসমূহ পরিদর্শন করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসক সৈয়দ আমজাদ হোসেন জানান, বন্যা দুর্গতদের সহায়তা প্রদানে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সবগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে ত্রান সামগ্রী পৌছানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক বন্যাকবলিত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করা হচ্ছে।