শোকের মাসে যত শোক

নেইমপাম নেইমপাম

বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২০

সায়েম মাহমুদঃ রক্তঝরা আগস্টকে বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস বলাটা নানাবিধ কারণে যথার্থই। বহু বছর ধরে এ একত্রিশ দিনকে শোক হিসেবে পালন করে আসছে দেশবাসী। এ মাসে সবচেয়ে বড় শোক নিঃসন্দেহে জাতির অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেের নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এছাড়াও মাসে আরো কয়েকটি শোকাবহ ঘটনা রয়েছে।

এ পর্বে  আমরা তেমন কয়েকটি শোকের ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করব যেগুলো এ দেশের জন্য এক অপূরনীয় ক্ষতির কারণ।

৭ আগস্ট ১৯৪১ঃ “আজ হইতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি ” – ১৪০০ সাল (চিত্রা), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯৬১ সালে শতবর্ষ পালনের পর ২০১১ সালে সার্ধশতবর্ষও পালিত হয় এ মহান কবির। ২০০৪ সালে করা বিবিসি র জরিপে সর্বকালের সেরা বাঙ্গালীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা, সব্যসাচী লেখক, কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, ও হাজার গানের সুরশ্রষ্ঠা।
মহাত্মা গান্ধী সাহেব কতৃক ঘোষিত “গুরুদেব” জন্ম গ্রহন করেছিলেন ১৮৬১ সালের ৭ ই মে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে৷ মাত্র তের বছর বয়সেই সে অবদান রেখেছিলেন বাংলা সাহিত্যে যার ধারা অব্যাহত ছিল ১৯৪১ সাল পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন অঙ্গন নাই যেখানে তার অবদান নেই আর এমনই একজন মানুষকে আমরা হারিয়েছে ১৯৪১ সালের এ আগস্টের ৭ তারিখ৷

তাকে নিয়ে আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ভূল ধারণা রয়েছে যে, তিনি নজরুলের বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও বাস্তবিক অর্থে তার কোন প্রমান তার কাজে কর্মে পাওয়া যায় নি বরং সে বিভিন্ন সময় নজরুলের পক্ষ হয়ে অন্যান্য সাহিত্যিকদের বিরোধিতা করেছেন৷ একবার নজরুল কোন কারণে জেলে অন্তরীন থাকাকালীন সময়ে তাকে রবি ঠাকুর “বাসন্তী ” নামক কাব্যটি তার জন্য উপহার হিসেবে পাঠায় যা নজরুলকে কিছুটা হলেও শান্তি দিয়েছে৷ এর কদিন পর নজরুল টানা ১৪ দিনের অনশনে যায় এ সময় রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে টেলিগ্রাম লিখেন

– ” অনশন ছেড়ে দাও,
আমাদের সাহিত্যে তোমাকে দরকার”।

১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ঃ শুধুই আগস্ট নয়, সারা বিশ্বে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ড গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল এ মাসেই। ১৫ আগস্ট রাতে কয়েকজন বিপদগ্রস্ত সেনা কর্মকর্তার হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পুরো পরিবার। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা ছাড়াও তার তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ও শিশু পুত্র শেখ রাসেলকেও তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন পড়ালেখার কাজে দেশের বাহিরে অবস্থান করায় বেঁচে যায় তার দু মেয়ে বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রপথিক শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা৷ শুধু নিজের পরিবারই নয় – এ হত্যাকাণ্ডে হত্যা করা হয়েছিল আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সদস্যদেরও।

এ ক্ষতি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি অপূরনীয় ক্ষতি – তিনি বা তারা জীবিত থাকলে হয়ত আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ দেখতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হত না। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা জাতির এমন স্বপ্নদ্রষ্টাকে অকালেই হারিয়েছি৷

১৭ ই আগস্ট ২০০৫ঃ দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পর এ দেশ যখন পুনরায় গনতন্ত্রের দিকে ফিরে আসছে তখনই একদল চক্রান্ত করছিল এ দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে। তারই ধারাবাহিকতায় এ দেশের জঙ্গিবাদের বীজ বপন শুরু করেছিল এক এক করে। ক্রমান্বয়ে হতে থাকা জঙ্গি হামলার এক পর্যায়ে সারা বাংলাদেশে এক সাথে সিরিজ বোমা হামলা করে ৬৩ টি জেলার (মুন্সিগঞ্জ বাদে) ৩০০ স্থানে ৫০০ টিরও বেশি বোমা হামলা করা হয়। যাতে নিহত হয় কমপক্ষে ২ জন এবং আহত হন ২০০ ও বেশি মানুষ। এসময় মূল টার্গেট ছিল সরকারি বিচার বিভাগের স্থাপনাসমূহ। প্রতিটি জেলার আদালতগুলোতে তারা হামলা চালিয়ে প্রচায় করতে থাকে যে, এ দেশে ইসলামি আইন চালু করতে হবে অচিরেই।
এটি বাংলাদেশের একটি কলংকজনক অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসের পাতার থাকবে চিরকাল

২১ আগস্ট ২০০৪ঃ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর ইতিহাসে আগস্ট সবসময়ই একটি ভয়ানক মাস। ২১-এ আগস্টও তার একটি। এদিন বিকেলবেলা ৭ আগস্ট সিলেটে বোমা হামলার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামিলীগ সভানেত্রীর প্রতিবাদী সভাস্হলে গ্রেনেড হামলা হয়। অল্পের জন্য প্রানে রক্ষা পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভাগ্যক্রমে প্রধানমন্ত্রী বেঁচে গেলেও ৩০০ ও বেশি নেতাকর্মী আহত হওয়ার পাশাপাশি নিহত হন কমপক্ষে ২৪ জন যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এর সহধার্মিণী আইভি রহমানসহ আরও অনেকে৷ প্রধানমন্ত্রীর উপর এ নিয়ে ২১ বার হামলা হয়েছিল, আল্লাহ র অশেষ রহমতে তিনি এখনও আমাদের মাঝে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন৷

২৯  আগস্ট ১৯৭৬ঃ আগস্ট যেন আমাদের কোন ভাবেই ছাড়ছে না। একের পর এক শোক ভর করছে এ মাসেই। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় কবি  কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং তার চিকিৎসার সকল বন্দোবস্ত করেন। চল্লিশের দশকের পর থেকে তিনি এক প্রকার অচল থাকলেও বাংলা সাহিত্যে নিয়মিত অবদান রেখে যাচ্ছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম৷ কিন্তু ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তার কলম থেমে যায়। বাংলা সাহিত্যের কয়েক হাজার গান, কবিতা, গল্প উপন্যাস আজও বাংলা সাহিত্য প্রেমীদের প্রেমের বিষয় হয়ে আছে। তার হারিয়ে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা আজও পূরণ হয়নি।

 

লেখকঃ সাবেক শিক্ষার্থী (ইংরেজি)  

আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়    

– smkiiuc@gmail.com