মুন্সি বাড়িঃ সহস্রাধিক মানুষের বেড়ে উঠা যেখানে-২

নেইমপাম নেইমপাম

বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২২, ২০২০

সায়েম মাহমুদ: শিরোনাম পড়েই অনেকে হয়ত আঁতকে উঠবেন -এক বাড়িতে এত মানুষ কি বলে!  হ্যাঁ! এত মানুষই – শত বছর আগে শুরু হওয়া এ বাড়ির সাথে সংযুক্ত থেকে বেড়ে উঠার স্মৃতি এ ইউনিয়নের প্রায় সকল মুরুব্বিদেরই আছে।কেন! কিভাবে  সেটাই বলব ‘ইব্রাহিম মুন্সি বাড়ির’ ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে লিখা ধারাবাহিক এ দ্বিতীয় পর্বে।

প্রথম পর্বেই আপনারা জেনেছেন আমার জন্ম ১৯৯০ এর দশকে। আমি যদি নিজের কোন অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার বা ভাগ করতে চাই তবে তা নব্বইয়ের দশকের পরেরই হবে৷ আজকের এ পর্বে আমি চেষ্টা করব আমার অহংকার, আমার বাড়ির হারিয়ে যাওয়া বা প্রায় হারাতে বসা কিছু ঐতিহ্য নিয়ে।

এক. সবচেয়ে বেশি যে ঘটনাগুলো মনের ভিতর দুঃখের কারণ হয় তা হল ইদের দিনে আমাদের বাড়িতে মানুষের আনাগোনা নাই দেখে৷ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেও এমন ঘটনা প্রায় প্রতিটি ইদেই দেখা যেত যে গ্রামের কয়েকশ মানুষ দল বেধে আমাদের ঘরে/বাড়িতে আসত, বাড়ির মুরুব্বিদের সালাম করত।

ইদুল ফিতর তথা রোজার ইদে আগের রাতের জাগার অভ্যাসের কারণে আম্মু ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে আমিও উঠে যেতাম৷ আমার খেলার সাথীদের নিয়ে কাজে লেগে যেতাম বাড়ির রাস্তা পরিস্কারের। সেসময় এক প্রকার প্রতিযেগিতা লেগে যেত কার আগে কে দরজা ( বাড়ির রাস্তা) পরিস্কার করবে৷ আমরা কোন রকমে পরিস্কার করে আসতেই দেখতাম আগে থেকে প্রস্তুত করা নারিকেল, কিশমিশ, বাদাম, চাল, দুধ নিয়ে আম্মু প্রস্তুত তার কর্মজজ্ঞ নিয়ে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বড় বড় তিন চার পাতিল পায়েশ ( আমরা যদিও নাস্তা বলতাম)  রান্না করে রাখত সবাই উঠার আগেই৷

এরপর শুরু হত একের পর এক মানুষের আগমন। আল্লাহর রহমতে আমার মায়ের হাতের পায়েস খেয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা বর্ণনা করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে৷ এমন কোন মানুষ হয়ত পাওয়া যাবে না যারা আমার মায়ের হাতের ডাল আর পায়েশের প্রশংসা করত না।

সময়ের ব্যবধানে সেসকল ঐতিহ্য আমরা হারাতে বসেছি – ২০১৪ সালে আমার বাবা মারা যান৷ ২০১৬ সালে নানা মারা যান এরপর ২০১৮ সালে আমার বড় জেঠা মারা যান৷ মানুষের সাথে সঙ্গত কারণেই আমাদের দুরত্ব বাড়তে থাকে আর কমতে থাকে দীর্ঘ দিনের পারিবারিক রীতি।

দুই. আজ মহররমের এক তারিখ যখন বাহিরে (চট্টগ্রাম বিহারী পল্লি) ঢাক ঢোল পেটানো দেখলাম। তখন আবেগাপ্লুত হয়ে ভাবছিলাম পুরানো সেই দিনগুলোর কথা। যখন আমাদের পরিবার থেকে প্রতি মহররমে ভোজের আয়োজন করা হত। আর শত শত মানুষ লাইন ধরে খাবার নিত। ২০১৪ সালে আমার বাবা মারা যাওয়ার কদিন পর থেকে আমার নানাও শারীরিক ভাবে দূর্বল হয়ে যায় যার কারণে এ ঐতিহ্যটিও আস্তে আস্তে কমতে থাকে৷

আগের সেই হারানো দিন এখন আর ফিরে আসে না। কোন উপলক্ষে আমরা কোন ভোজের আয়োজন করলেও আগের সে আমেজ আর মিলে না।

তিন. আমার স্পষ্ট মনে আছে, একদিন আসরের নামাজ আদায় করব বলে অযু করতে টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে দেখি দীর্ঘ লাইন। সবাই সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দিল কারণ।অযু করতে গিয়ে ভুল করে ফেলায় আমার এক ক্লাসমেট ‘রাবেয়া’ হেসে বলতেছে,  “কাজল কয়বার পা ধুতে হয় ভুলে গেছ নাকি “।

রাবেয়াদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে কয়েকশ গজ দূরে অবস্হিত। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত, একশ দুশ তিনশ মিটার দূর থেকে এসেও মানুষ আমাদের বাড়িতে থাকা সেই টিউবওয়েল থেকে পানি নিত।

অন্য এলাকায় হয়ত তখন ভাল পানি উঠত না। কারণ যাই হোক সেসকল স্মৃতি সত্যিই মনে রাখার মত, শত শত মানুষ প্রতিদিন টিউবওয়েলের কাছে এসে ভীড় করত একদম সকাল সকাল শেষ হতে হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হত। এখন হয়ত সবার ঘরে ঘরেই টিউবওয়েল আছে, কিন্তু হারিয়ে ফেলা সে ভাললাগা বা স্মৃতি কি আর কখনও ফেরত আসবে?

চার. প্রায় দুশ শতাংশ বা দু একর জায়গার উপর করা দীঘিতে গোসল করে নি এমন মানুষ পুরো ওয়ার্ডে একটাও পাওয়া যাবে না। মাঝে মাঝে ফজর নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যেতেও দেখতাম মানুষ গোসল করে আবার এশা পড়তে বের হলে তখনও কাউকে কাউকে গোসল করতে দেখা যেত এ পুকুরে৷

আমাদের বাড়ির সামনেই লাগানো একটি স্কুল ও মাদ্রাসা থাকায় ঐ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার পর ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে নামতো এ পুকুরে। শীতকালে মাদ্রাসার বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায় এটিই ছিল সাঁতারের ভ্যানু।

বিশেষ করে শীতকালে গ্রামের কোন পুকুরেই পানি থাকত না তাই পুকুরের চার পাশেই মানুষ গোসল করার ব্যবস্থা থাকত। শুধু গোসলই না, কেউ কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিত খোশগল্প করতে করতে। পুকুর পাড়ে যাই, গোসল করি, সাঁতারও কাটি কিন্তু আগের সে শান্তি কেন যেন পাই না আর।

পাঁচ. আমাদের বাড়ি থেকে বের হলেই একটি মাদ্রাসা আর একটা সাইক্লোন শেল্টার বা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে৷ ২০০০ সালের দিককার কথা, তখন দু বছর হল মাত্র আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ এর খুটি আসল। সংযোগও পেয়েছি আমরা। কিন্তু বাজার থেকে শুরু করে আশপাশের আর কোন বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। অন্যদিকে প্রচন্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে মানুষ যখন ঘুমাতে পারত না, তখন সবাই পাতলা কাঁথা আর একটা বালিশ নিয়ে চলে আসত সাইক্লোন শেল্টারের নিচের খালি জায়গায় ঘুমাবে বলে৷ উল্লেখ্য, চারপাশে কোন ঘর না থাকায় এখানে প্রচুর বাতাস থাকত আর মানুষ আরাম করে ঘুমাতে পারত।

প্রতি বছরে একবার বিদেশি দল ( কথিত আছে তারা আফগান বা আরব বংশদ্ভূত)  সুরমা, কাজল বিক্রি করতে একদল মানুষ থাকার সব উপকরণ নিয়ে ভীড় করত এখানে৷ তারপর সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে বিক্রির উদ্দেশ্যে বের হত এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম।

আরেকটা মজার ঘটনা ছিল যখন জেলেরা মাছ ধরা শেষে কূলে আসত তখন তারা এ সাইক্লোন শেল্টার, আমাদের বিশালাকার বাড়ির দরজায় বসে ছেঁড়া-ফাটা জাল বুঁনতো(তুঁনতো)।

এ বাড়িটির ইতিহাস শত বছরের – শত বছরে শতাধিক পরিবার এ বাড়ির আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রিতরা জায়গা ছেড়ে নিজেরা জায়গা কিনে সাবলম্বী হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে অনেক। বর্তমানে আবার মানুষ নদী ভাঙ্গা কবলে পরে এ বাড়ির মানুষের আশ্রয় নিয়েছে।হাজার হাজার মানুষ জন্মলগ্ন থেকেই নানানভাবে এ বাড়ির মানুষের উপর নির্ভরশীল ছিল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ।

যেসকল মানুষ নদী ভাঙ্গার কবলে পরে অসহায় হয়ে যেত তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল এ একটি বাড়ি – হাজি ইব্রাহীম মুন্সি বাড়ি।

বর্তমানে হয়ত অনেক মানুষের অনেক টাকা পয়সা হয়েছে তারা নিজেদের কেনা সম্পত্তিতে ঘর তুলে থাকছে।নিজের মত করে সব করছে । কিন্তু পুরানো সে স্মৃতি বা আনন্দ কোনটাই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।আধ্যাত্মিক সুখ ভুলে মানুষ দিনদিন জাগতিক সুখের পেছনে ছুটছে। যার কারণেই হয়ত আজকের এ পরিণতি।

(প্রথম পর্ব: (লিংক) ::::  মুন্সি বাড়ি: মেঘনার ভাংগন কবলিত অলিখিত আশ্রয়কেন্দ্র

 

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী (ইংরেজি)

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

ইমেইল: smkiiuc@gmail.com