জীবনবোধ: তিনের নামতা

Zobaer Zobaer

Hasan

প্রকাশিত: ৮:১৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২১

ইন্টারনেট থেকে: মুদি দোকানে ডিম কিনতে গিয়েছি। পাশে এক লোক বাচ্চা নিয়ে দোকানে এসেছে। লোক টা সম্ভবত শ্রমিক বা রিকশাচালক। শুকনা। কন্ঠার হাড্ডি বের হয়ে গেছে। অভাব অনটন তাকে কেমন জীর্ণশীর্ণ করে দিয়েছে। তার বাচ্চা টার ও একই অবস্থা। লোক টা ২৫০ গ্রাম তেল আর লবন কিনতে এসেছে। বাচ্চা টা জুলজুল চোখে লজেন্সের বয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারা চাইতে সাহস পাচ্ছে না। ওর বাবা সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দারিদ্র্য মাঝে মাঝে চোখে নিঃলজ্জ টিনের চশমা পড়িয়ে দেয়। সেই কথিত “চশমার” আড়ালে ছেলের মায়াভরা মুখটা দেখে ভালোবাসায় ভেজা গলায় বাবা টা বল্লো, “কিছু লইবি?”

ছেলে টা লাজুক ভাবে কথা না বলে আঙ্গুল তুলে দেখালো। বাবা হেসে লজেন্স এর বয়ামের কৌটা খুলে দুই টা লজেন্স বের করে ছেলে কে খুব আদর করে বলো, “তিনের ঘরের নামতা টা কও তো বাপ”

বলেই লোক টা আড়চোখে সবার দিকে হালকা তাকালো। তার সেই দৃষ্টি তে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা। যদি না পারে! সবাই তো তাকিয়ে আছে!

ডিম এর পুটুলি হাতে নিয়ে আমিও তাকিয়ে আছি ছেলে টার দিকে।

মাসুদ দোকানদার ও সরু চোখে তাকিয়ে আছে। এই পিচ্চি পোলা! নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, সে বলবে তিন এর ঘরের নামতা! এই কঙ্কালসার ছেলে তিনে তিনে কত হয় সেটাই তো জানে না!

ছেলের হাতে লজেন্স। সে লজেন্স দুই টা এহাত-ওহাত করছে। বাবার দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে স্পোর্টস কারের গতিতে সে বলতে শুরু করলো

“তিন অক্কে তিন, তিন দুগুনি ছয়, তিন তিরিক্কা নয়, তিন চাইরে বারো ….”

কেমন টেনে টেনে গানের তালে মাথা নেড়ে নেড়ে সে বলে যাচ্ছে। বাবার চোখে যেনো নামতার পাতা টা সেঁটে আছে, ও শুধু দেখে দেখে পড়ে যাচ্ছে।

নামতা শেষ হলো ত্রিশ কি চল্লিশ সেকেন্ডে। শেষ করে সে একটা লজেন্স মুখে পুড়লো। মুখ ঝলমল করে বাবা কে বল্লো, “আব্বা, চাইরের নামতা ও পারি! কমু?”

সেই জীর্ণ লোক টা, হয়তো প্রতি দিন ঠিক মতো পয়সা পায় না। পাচ টাকা বেশী রিকশা ভাড়া চাইলে দুই চার টা গালি খায়, মহাজনের গুতা খায় আর পুলিশের মার খায়।

সেই গাল ভাঙ্গা কুজো হয়ে যাওয়া লোক টা প্রতিদিন ই হেরে ই যায়। সমাজের কাছে, সংসারের কাছে, পিতৃত্বের কাছে।

 

আজ সে হারে নি। আজ তার অনেক বেশি আনন্দ। সবার সামনে ছেলে তার মুখ উজ্জ্বল করেছে। এবার সে আড়চোখে না, পূর্ণ দৃষ্টি তে আমাদের সবার দিকে তাকালো। তার চোখে গর্বের অশ্রু, আনন্দাশ্রু। মুখ টা গম্ভীর।

যে লোক শুধু পরাজিত ই হয়, আমাদের চোখে, আসলে সে পরাজিত না। সে আসলে অনেক বড় যোদ্ধা। আমাদের চেয়ে অনেক সাহসী। আমরা তো যুদ্ধের আগে নানান পরিকল্পনা করি, কত ফন্দিফিকির, কাকে নিচে নামিয়ে কাকে মাড়িয়ে আমরা উপরে উঠবো।

কিন্তু এই লোক গুলো কাউকে মাড়িয়ে উপরে উঠতে চায় না, নিশ্চিত পরাজয় জেনে ও প্রাণপণ যুদ্ধ করে যায়।

যে সিড়ি বেয়ে আমরা তড়তড়িয়ে উপরে উঠে যাই, আমরা কি জানি তাদের কাধের উপরই সেই সিড়ি চাপানো!

লোক টা আজ সাহস পেয়েছে। তিনের ঘরের নামতাটা শুধু নামতা নয়, একটা সাহস, একজন বাবার শক্ত একটা কাধ, একটা অবলম্বন। তিনের ঘরের নামতাটা এই দরিদ্র লোকটার স্বপ্ন পুরনের উপাখ্যান।

লোকটা তার ছেলে কে কোলে তুলে ফেল্লো। সে কেঁদে ই ফেলেছে। এই সময় হুট করে মাসুদ দোকানী ডীপ ফ্রিজ খুলে একটা ললি আইসক্রিম পিচ্চির হাতে দিলো। “সাবাস! জজ ব্যারিস্টার হইয়া দেখায়া দিস সবাইরে! ল, আইসক্রিম খা। বেশি খাইস না, গলা ফুইলা কথা কইবার পারবি না”

ছেলে টা খুশি মনে আইসক্রিম টা নিলো। বাবা ছেলে চলে গেলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।

মাসুদ আমাকে বল্লো, “আমি তো ভাববার ও পারি নাই। বান্দর টা কেমনে চ্যালচ্যালাইয়া নামতা কইয়া দিলো! দেখলেন নি কারবার ডা!”

একি! মাসুদের চোখেও পানি! আসলে যারা খুধার কষ্ট বোঝে, তাদের একজনের মনের সাথে অন্যজনের মন একই সুতোয় গাঁথা থাকে। একজনের কষ্ট আরেকজন বুঝতে পারে, আবার আনন্দ গুলোও স্পর্শ করে।

আর আমরা? কোটি টাকার স্বপ্নে আর প্রতিযোগীতার উন্নাসিকতায় ভুলে যাই আমরা আসলে কি!!!

আমি ডিম হাতে একা একা ই বলছি, “তিন অক্কে তিন, তিন দুকুনে ছয় …”

আমাকেও সংক্রামিত করেছে তাদের জয়ের আনন্দ।

 

  • সাব্বির ইমন