সরকারি চাকরি ও শিক্ষার্থী ভর্তিতে কোটা, দলীয়করন নয়

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২১

মারজাহান আক্তার:

চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে ৭ দিনের আল্টিমেটাম। সন্তান ও প্রজন্মের বয়সসীমা ৩৫ সহ ৬ দফা দাবি(১৫ জানুয়ারি.২০২১, কালের কন্ঠ)। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ কোন গৃহকর্ম বা দোকানের কাজ নয় যে তা যেকোন লোকই করতে পারবে বা যেকোনো ভাবে করলেই চলবে। রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ অতিব গুরুত্বপূর্ন কাজ সেই কাজগুুলো করার জন্য প্রয়োজন হয় জ্ঞানী, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির যাদের সাথে জড়িয়ে থাকে দেশের হাজার হাজার, লাখো লাখো মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়। অর্থ্যাৎ একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার জন্য দরকার জ্ঞানী, বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ মানুষের। মানুষ নিজে নিজে জ্ঞানী, বিজ্ঞ হয় না। মানুষকে ‘জ্ঞানী ও বিজ্ঞ’ করে তৈরি করতে হয়। এই তৈরির কাজ কে করবে? করবে অভিভাবক, রাষ্ট্র ও নিজের প্রচেষ্টা। ‘অভিজ্ঞ’ হবে জ্ঞানী ও বিজ্ঞরা সময়ের পরিক্রমায় নিজেদের জ্ঞান ও কর্ম দক্ষতার পরিচয় দেয়ার মাধ্যমে।

যদি এটা মনে করা হয় রাষ্ট্রের সকল মানুষই হবে জ্ঞানী ও বিজ্ঞ তাহলে সেই মনে করাটা মোটেও সঠিক হবে না। কেননা মানুষকে ঘুম থেকে উঠে পরের দিনের ঘুম থেকে উঠা(চব্বিশ ঘন্টা) পর্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে যেসব কর্ম সম্পাদন করতে হয় তা কোন মানুষের পক্ষে এককভাবে সম্পন্ন করা সম্ভবপর হয় না, সম্ভব হয় সম্মেলিত সহযোগিতার মাধ্যমে। আর এই জন্য মানুষ তার জীবনের অধিকাংশ প্রয়োজন মেটাতে অন্য মানুষের উপর নির্ভরশীল থাকে। ঠিক একিরকম করে একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় বলে রাষ্ট্র তার সকল ধরনের প্রয়োজন সুচারু রুপে সম্পন্ন করার জন্য সকল শ্রেণির মানুষের সহযোগিতা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই সকল মানুষের কর্মের সমষ্টিই জীবন, রাষ্ট্র। যেহেতু কর্মগুলো সব এক ধরনের নয় তাই রাষ্ট্রের সকল মানুষই জ্ঞানী, বিজ্ঞ হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তার মানে এটা নয় যে সম্মান পাবে শুধু দেশের জ্ঞানী ও বিজ্ঞরা। জীবনের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ করতে যেহেতু সকল শ্রেণির মানুষের সাহচার্য্য আবশ্যক তাই সম্মানের ভাগিদার সকল শ্রেণীর মানুষ, কেউ খাটো নয়।

আমি তো এটা মনে করি একজন মানুষ যতক্ষণ নিজ পায়ে হাঁটতে সক্ষম ততক্ষণ তিনি কোন লাঠির আশ্রয় নেন না। লাঠির আশ্রয়টা ঠিক তখনি নেন যখন তিনি নিজ পায়ে হাঁটতে অক্ষম হয়ে পড়েন বা হোন। রাষ্ট্র পরিচালনায় দরকার জ্ঞানী ও বিজ্ঞদের। যিনি জ্ঞানী ও বিজ্ঞ নন তিনি নিশ্চয়ই রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নিতে অক্ষম ব্যক্তি এটা নিশ্চয়ই আপনারাও আমার সাথে এক বাক্যে স্বীকার করবেন। তো আপনারা কি মনে করেন রাষ্ট্র পরিচালনার মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অক্ষম ব্যক্তির জায়গা হওয়াই উচিত? আমার মতে উচিত নয়। কেননা যে নিজে অক্ষম সে কিভাবে সুন্দর করে রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষমতার পরিচয় দিবে? আর অক্ষম যোগ্য জায়গায় বসানোর কারনে স্বাধীন বাংলাদেশ ৫০ বছর পূরণ করে ও সকল বিষয়ে এতটা এতটা পিছিয়ে যে বাংলাদেশের মান এখনও অনুন্নত দেশের মানের পর্যায়ে রয়েছে শাসন ব্যবস্থা, শুশাসন, নৈতিকতা, আর্দশিক মানদণ্ড সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মান এখনও সর্বনিন্ম পর্যায়ে।

“কেউ যদি মনে করেন তিনি পাবলিক বা সরকারি স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত এবং তিনি জ্ঞানী ও বিজ্ঞ বা দেশ পরিচালনায় অংশ গ্রহণের উপযুক্ত তাহলে তিনি তার যোগ্যতা প্রমাণ করবেন রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে শীর্ষ স্থানের অধিকারী হওয়ার মাধ্যমে। কোটা, দলীয় আশ্রয় নেয়ার মধ্য দিয়ে নয়”। যদি কেউ নিজেকে যোগ্যই মনে করেন তবে কেন তিনি কোটা, দলের আশ্রয় নেন? কোটা, দলের আশ্রয় তো তিনিই নিবেন যিনি অক্ষম বা যোগ্য নন কিন্তু যোগ্য আসনে বসবেনই যেকোনো মূল্যে। যিনি কোটা, দলের আশ্রয় নেন তিনি কি এটা বুঝেন না! কোটা, দলের আশ্রয় নিলে এটা প্রমাণিত হয় তিনি এটার অযোগ্য? নিজ চোখে দেখেছি একজন শিক্ষার্থী কঠোর সাধনা করার পরও পাবিতে ভর্তি হওয়ার যোগ্য হয়না, ভালো বিষয়ও পায়না সেখানে স্বল্প মেধাবী বা স্বল্প পরিশ্রম করে (যে সত্যিকারের যোগ্যই নয়) একজন কোটাদারী পাবিতে শুধু ভর্তিই হয় না বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিষয়গুলোতে পড়ারও সুযোগ পায়, যা কঠোর পরিশ্রমকারী শিক্ষার্থীর জন্য খুবই বেদনাদায়ক। একিকথা সরকারি স্কুল, কলেজ ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোটায় পাওয়ার পরও এদের উচ্ছ্বাস দেখে যেমন অবাক করার মত তেমন যারা কঠোর সাধনায় এদের জন্যই সুযোগ পায় না তাদের জন্য অপমানকর। সরকারি চাকরিতে যোগ্য ব্যক্তি স্থান না পেয়ে পায় কোটা, দলের ব্যক্তি যা সত্যিই অপমানকর ও বেদনাদায়ক। আমি বিশ্বাস করি অক্ষম বা অযোগ্যদের যোগ্য আসনে বসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেই কোটা, দলের আশ্রয় নেয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবেন এই অযোগ্যরা যখন যোগ্য আসনে বসে তখন নিজেদের যোগ্য প্রমান করতে ও টিকে থাকতে আশ্রয় নিয়ে থাকে নানা অপকর্মের। আর অপকর্ম চালিয়েই তারা নিজেদেরকে কর্মে টিকিয়ে রাখে। কেন আল্লাহ তায়ালা তাদের এই অপকর্মে সহায়তা করেন তা অবশ্য আমার জানা নেই।

যেকোন দলীয় পরিবারের সন্তান, মুক্তি যোদ্ধার সন্তান, পোষ্য সন্তান ইত্যাদি ইত্যাদি (মানবিক কারন) এরা অন্যান্য সরকারি চাকরির জন্য প্রযোজ্য হলেও শিক্ষকতা পেশার জন্য আমি মনে করি একদমই নয়। কারন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ পেতে ৩টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ মেধা, শিক্ষার্থীকে দেয়ার স্বক্ষমতা, চারিত্রিক গুণাবলি। এই ৩ টি বিষয় না দেখে যখন কোন মানুষকে উপরের বিষয়গুলো দেখে শিক্ষক নিয়োগ দেয় তখন সেসব শিক্ষকরাই ‘শিক্ষার গুনগতমান ও শিক্ষার্থী উভয়কে কলুষিত করে’ এরাই নিজেদেরকে জ্ঞানী প্রমান করতে করে অন্যায় কাজগুলো। এছাড়া শিক্ষার গুনগতমান ধরে রাখতে ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ‘শেষ দুটো’ পেশাজীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত মনিটরিং এ রাখা উচিত।

রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ দিয়েছে তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের সুযোগ দিয়েছে ঠিক আছে। এরপর আবার তাদের নাতি নাতনি, বয়স ৩৫, প্রজন্মের পর প্রজন্ম আরো আরো এতো কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের এতো প্রাপ্যতার দাবি কি সময়োপযোগী যৌক্তিক কোন দাবি হতে পারে বলে আপনারা মনে করেন? এতোই বা কেন? মুক্তিযোদ্ধা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের সুযোগ দেয়ার পরও রাষ্ট্র যদি মনে করে, সাধারণ মানুষ হতে যোগ্য, মেধাবীদের বঞ্চিত করে তাদের আরও সহযোগিতা করতে হবে তবে তা অন্যভাবে করবে পাবিকস্কুলে ভর্তি বা সরকারি চাকরিতে বা রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে নয়। অযোগ্যদের জায়গা অন্য কোথাও রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে তো একদমই নয়। সাধারনের বেলায় সর্বোচ্চ মেধার যোগ্যতা দেখিয়ে আসতে হয় তাদের বেলায় অল্প মেধাই যথেষ্ট হয়ে যায়। রাষ্ট্র এটা কি বুঝে না! “অল্প মেধাবীরা যখন সর্বোচ্চ মেধাবীদের জায়গায় বসার সুযোগ পায় তখন তারা ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করে আত্নহংকারে অন্যায়ের গোটাডাউন হয় এবং অন্যায়ের বিস্তৃতি ঘটায়”।

রাষ্ট্র পরিচালনার কাজের জন্য রাষ্ট্রে যোগ্য, জ্ঞানী ও বিজ্ঞ(মেধাবী) থাকা স্বত্ত্বেও তাদের সুযোগ না দিয়ে, সেখানে কেন অযোগ্য(যে নিজে প্রমান করছে সে যোগ্য নয়) অক্ষম ব্যক্তিদের রাষ্ট্র সুযোগ দিচ্ছে তাও আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্র চলবে তার আর্দশিক মানদণ্ডে রাষ্ট্রের ভিত্তি গুলো গঠিত ও চালিত হবে নৈতিক নিয়মে। কেন রাষ্ট্রকে অন্যের অন্যায় আবদার শুনে তা মেনে চলতে হবে? এরকম সুযোগ ও নিয়োগ প্রাপ্ত কোটাদারীদের আমরা অযোগ্য মনে করে মন থেকে অবশ্যই ঘৃণা করতে পারি। কোটায় আসার পরও এদের মধ্যে নূন্যতম লজ্জাবোধ না দেখে এদের অন্যায় করার দুঃসাহসগুলো সত্যিই বিষ্ময়কর!

রাষ্ট্র পরিচালনার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে কোটা(প্রথম দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরীতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি. ৮ অক্টোবর, ২০১৮. প্রথম আলো) না রাখার সিদ্ধান্ত সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত হয়েছে সাথে দলীয় কোন লোকও নয় এরকম সিদ্ধান্ত আরও বেশি সময়োপযোগী সাথে সরকারি স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ না দেয়াও সময়োপযোগী। এই দুই ক্যটাগরিতে যারা আসবে তারা কোটা বা দলীয় হয়ে নয় বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে যোগ্যতার পরিপূর্ণ প্রমান দিয়ে আসবে। তবে এখানে যেসব যোগ্য, মেধাবীরা আসবে তারা যেন আত্নাহংকার ও কোন রকমের অন্যায় করতে না পারে তার জন্য রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে। যোগ্য আসনে বসে যদি অযোগ্য কাজ করে নিজের যোগ্যতা বা সম্মান ধরে রাখতে না পারে তার দায় যেন রাষ্ট্র কোনভাবেই না নেই। তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন কল্যাণময়ী হবে রাষ্ট্র ও তার প্রতিটি জনগণ।

(এটি লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে সম্পাদকীয় নীতিমালার কোন সম্পর্ক নেই।)

 

লেখক: ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী ও এমফিল গবেষক, নোয়াখালী