মুন্সি বাড়িঃ বাহারি ফলের পাকনামিনামা, পর্ব-৩

নেইমপাম নেইমপাম

বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ৯:১৫ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২০

সায়েম মাহমুদ: ২৬প্রজাতির ফলে ভরপুর বাড়িটি।উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে আমড়া, সুপারি, নারিকেল, কাঠাল, আম গাব, চালতা ইত্যাদি উল্লেখ করার মতো।বাড়ির চারপাশে বিভিন্ন রকম গাছের ফল আনতে গিয়ে দুষ্টমি, রাগারাগি, কষ্ট ও মধুর স্মৃতি নিয়ে থাকবে যত বর্ণনা।

এক. সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ঘরের সাথে লাগানো গাছের আমড়া পাড়ার দৃশ্যটা। আমাদের সে গাছটিতে সবসময়ই তিন সাইজের ফুল ও আমড়া থাকত সাথে  থাকত৷ অনেকে এটাকে বারোমাসি ফলনও বলে থাকে।

এক সাইজের গুলো বিক্রি করত। আরেকটা তার চেয়ে একটু ছোট ছিল। এর পরের সাইজ আরও একটু ছোট ছিল৷ বলা চলে সবসময়ই গাছে আমড়া লেগে থাকত। ঐ গাছটিতে যা ২০১০সালে আমাদের থাকার ঘরটিকে পুনঃনির্মাণের সময় কেটে ফেলা হয়েছিল৷ মোট তিনটা আমড়া গাছ থাকলেও গ্রামের সকল মানুষের নজর ঐ একটাতেই ছিল ।

প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই মানুষ রাতে ঝরে পড়ে থাকা আমড়া কুড়াতে আসত।যা পেত নিয়ে যেত৷ এর কিছুক্ষণ পরই আমড়া কেনার জন্য পাইকার এসে বসে থাকত। উনার চাহিদামত আমড়া নিয়ে উনি চলে যেতেন।  আর আমরা বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বসতাম ভাগ বাটোয়ারায়।

আমড়া পাড়ার জন্য একজন গাছে উঠত কিন্তু নিচে থাকতে ডজনখানেক বাচ্চা ছেলে মেয়ে।যারা উপর থেকে পড়া আমড়া কুড়িয়ে এক জায়গায় জড়ো করত।

২০১০সালে সামনের পেছনের আমড়া গাছ দুটো কেটে ফেলা হয়েছিল। যার কোন নিশানাও নেই এখন। ৫০-৬০ ফুট গাছটি দিয়ে চুলায় জালানো ছাড়া আর কোন উপকার হয়নি। কথায় আছে, না? আমড়া গাছের ঢেঁকি!

দুই. সুপারি পাড়ার জন্য লোক খুজাটা একটা কসরতের ব্যাপার ছিল৷ প্রতি সপ্তাহে একবার করে আমাদের সব গাছের সুপারি পাড়াতাম। পাড়ানোর জন্য দু-তিনটা ছেলে লাগত। যারা এ গাছ থেকে ও গাছ বেয়ে সব পাকা সুপারি নিয়ে নামত সুপারম্যানের মত।

সবচেয়ে বেশি মনে পরে মকবুল, ইসহাক আর রুবেলের কথা। এদের মধ্যে রুবেল আর ইসহাক দুই ভাই। তিনজনই গাছে উঠায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি ছিল রুবেল। এক গাছে উঠে সর্বোচ্চ সাত গাছ থেকে সুপারি নিয়ে নামার রেকর্ড আছে তার। পাঠক! আপনি যদি লক্ষ্মীপুর বা ভোলার মানুষ না হয়ে থাকেন তবে আপনার কাছে রুবেলের সে আচরণ দেখলে স্পাইডার ম্যান ইন রিয়েল বলতে সময় লাগত না!

তারা তখন সুপারি গাছে উঠত আর আমরা নিচে থেকে বলতাম কোনটা নামাতে হবে আর কোনটা হবে না। নামানো শেষে আমরা সবগুলো সুপারি নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করতাম। তারপর আব্বু ব্যাপারী ঢেকে সবগুলো বিক্রি করে দিত। আমাদের পুরো ইব্রাহিম মুন্সি বাড়ির জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে এ ছোট প্রজাতির ফল সুপারি।

তিন. গ্রীষ্মকালের প্রধান ফল কাঁঠাল। আমাদের জাতীয় ফলও!আমাদের বাড়িতে যত কাঁঠাল হত তার অর্ধেকেরও বেশি কাঠাল হত শুধু একটা গাছেই। বর্তমানে সে গাছটির অস্তিত্ব নেই – গেল কয়েক বছর আগে সে গাছের কাঠ দিয়ে কিছু ফার্নিচার তৈরি করা হয়েছে।

আমি তখন স্কুলে পড়তাম।একদিন স্কুলে যাওয়ার আগেই গাছ থেকে কাঁঠাল নামিয়ে ঘরে রেখে গিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিনও অন্যদিনের মত আমি স্কুল পালিয়ে চলে আসি। আসার পর আমার আব্বু আম্মুকে বলতেছে দেখছ, কেমন ছুঁচা, কাঁঠালের জন্য ও স্কুল ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছ!

কাঁঠালের প্রতি আমার সবসময়ই একটা অন্যরকম ভালবাসা কাজ করত – বড় গাছটায় একেবারে উপরের কাঁঠাল পাড়ার জন্য অনেক কষ্ট হত৷ একবার উপরে উঠে খেয়াল করলাম একটা কাঁঠাল পেকে আছে। হঠাৎ বুদ্ধি আসল এটা যেহেতু নামাতে কষ্ট হবে কিছু কোষ খেয়ে হালকা করে ফেলি৷ সেখানে বসেই বৃহৎ অংশ শেষ করে ফেলেছিলাম সেদিন৷

চার. জাতীয় গাছের অজাতীয় ফল আম পাড়ার তেমন কোন স্মৃতি আমার নেই। কারণ প্রতি বছরে আম পাড়া হত মাত্র একবারই। জৈষ্ঠ্য মাসে যখন আম পাকা শুরু হত আব্বু আর আমি মিলে সব আম একবারে পেয়ে বস্তা ভরে নিয়ে আসতাম৷ তবে স্মৃতিময় হত যখন আমার চাচারা (যারা এ বাড়িতে থাকে না)  আসত আম নিতে, তখন খুব মজা হত। উনারা আসলে আমরা সবাই মিলে আনন্দ করতাম, আম খেতাম।

পাঁচ. আমার চাচা, চাচাত ভাইয়েরা প্রায় সময়ই আসত কখনও আম, কখনও কাঁঠাল, কখনও ডাব-নারিকেল, আবার কখনও সুপারি নিতে৷ চাচারা যখন আসত তখন তারা বস্তা ভরে এসব ফল নিয়ে যেত। যারা সামনে থাকত তাদের সকলকে কিছু কিছু দিয়ে যেত।

আজকের পর্ব শেষ করতে হচ্ছে তবে এতেই শেষ নয়। তাল গাছের তাল কুড়ানোর সেসব স্মৃতি, পেপারা গাছে ঝুলার স্মৃতি, জাম্বুরার ঝাঁজালে রসে যখন চোখে আসত তার চিল্লানি। খেজুর গাছে আধাপাকা ফল এনে পানিয়তে ভিজিয়ে রাখা আর খাওয়ার পর টয়লেটে দৌড় দেয়া! কোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়৷ তবুও শেষ করতে হচ্ছে অন্যকে জায়গা করে দিতে- পরবর্তী পর্ব পড়ার অগ্রীম দাওয়াত দিয়ে শেষ করছি।

(পড়ুন পূর্বের দুটি পর্ব:  মুন্সি বাড়িঃ সহস্রাধিক মানুষের বেড়ে উঠা যেখানে-২    মুন্সি বাড়ি: মেঘনার ভাংগন কবলিত অলিখিত আশ্রয়কেন্দ্র।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

smkiiuc@gmail.com