মুন্সি বাড়িঃ একঝাঁক সফল তারুন্যের গল্প (পর্ব-৪)

নেইমপাম নেইমপাম

বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ৯:২৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০

সায়েম কাজল: “তিরিশের নিচে যারা তারাই পাল্টাবে পৃথিবী ” – স্টিভ জবস্ এর আলোচিত উক্তি এটি লেখাটা যখন লিখছি তার ঠিক এগারো ঘন্টা আগে উদীয়মান লেখক, সমাজসেবক, ও মোটিভেশনাল বক্তা বাদল সৈয়দ স্যার তার একটি লিখায় এ উক্তিটি ব্যবহার করেন৷ স্যারের কথায় তরুনরাই দেশের সম্পদ, তারাই পারে যেকোন কিছুকে পাল্টে দিতে। আমাদের হাজি ইব্রাহীম মুন্সি সাহেবের উত্তরসুরীদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন উদ্দীপ্ত তরুনের কথা লিখতেই আজকের পর্বে হাজির হয়েছি।

আহমেদ শরীফঃ দাদার কাজের যে ফিরস্তি তা শুনে সবাই মুগ্ধ হবে- কিন্তু এমন একটা মানুষের দেখা পাওয়া হয়নি আমার। তাই উনার ব্যাপারে জানতে পরিবারের বড়দের দারস্থ হতে হয় প্রতিবারই। সরাসরি দাদাকে দেখছেন ও আদরের সম্পূর্ণটা পেয়েছেন এমন একজন আহমেদ শরীফ ভাই (সম্পদ ভাই)। মরহুম আহম্মদ উল্লাহ’র বড় ছেলে মরহুম আব্দুস সালামের বড় ছেলে শ্রদ্ধেয় আহমেদ শরীফ ভাই বর্তমানে চৌধুরী হাট ডিগ্রি কলেজে লেকচারার হিসেবে কাজ করছেন। এর আগে তিনি মোবাইল কল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক ও বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ এর কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন৷ শিক্ষা জীবনে বরিশাল বি.এম কলেজ, আ স ম আব্দুর রব সরকারি ও আলেকজান্ডার পাইলট হাই  স্কুলে পড়ালেখা করছেন।

সোহেল আহম্মেদ সাফাঃ আহম্মদ উল্লাহ’র বড় ছেলে, শিক্ষক দম্পত্তি আব্দুস সালামের ছোট ছেলে সোহেল সাফা। তিনিও বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় আছেন ভোলার দৌলতখানের সুখদেব মদন মোহন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের  ভোকেশনাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে। এর আগে তিনি জাপান ভিত্তিক নিপ্পন গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।

শিক্ষা জীবনে তিনি আলেকজান্ডার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬সালে এসএসসি পাশ করেন। এরপর ফেনী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে তিন বছর মেয়াদি কোর্সে মেকানিকাল ইন্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন। ট্রান্সফার জনিত কারনে কুমিল্লা পলিটেকনিক থেকে ২০০০সালে উত্তীর্ন হন। শিক্ষকতা পেশায় আরও অধিকতর দক্ষতা অর্জনের নিমিত্তে তিনি বিএড সহ আরও কয়েকটি প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন৷

শোয়েব মাহামুদঃ ২০১৪ সালের আগে গ্রামের মানুষ যাকে ঘরে দেখলে জিজ্ঞেস করত উনি কোত্থেকে আসছেন! তিনি আব্দুল বাসেত সাহেবের বড় ছেলে শোয়েব মাহমুদ বাদল। তরুন এ সমাজ সেবক সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্বটুকু অনুভব করতে পেরে প্রতিষ্ঠা করেছে “সদিচ্ছা ফাউন্ডেশন” নামের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। যা থেকে যেকোন দুর্যোগকালীন সময়ে অসহায়ের দাঁড়ানো হয়। কর্মজীবনে তিনি বেসরকারি ব্যাংক ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক লিমেটেডে কর্মরত আছেন ২০১৪ সাল থেকে৷ এর আগে তিনি ঢাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন৷ শিক্ষা জীবনে তিনি ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ। ঢাকা তিতুমীর কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং বরিশাল বিএম কলেজ থেকে একই বিষয়ে শেষ করেন। স্কুল থেকে বেরিয়েই বাড়ি ছাড়া মানুষটি ভোলা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক  ও বালুরচর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন৷

জিল্লুর রহমান (সাথী):  আমার চাচাত ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে কম দেখা মানুষটি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান ইমন ভাই।তিনি বর্তমানে ইকরা সফ্ট লিমিটেডের নেটওয়ার্ক ও সিস্টেম সাপোর্ট ইন্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন৷ উনার বাবা জনাব মো: ইউসুফ এর চাকুরী সূত্রে ছোট বেলা থেকেই রাজধানী ঢাকাতে অবস্থান করছেন পুরো পরিবার৷ শিক্ষা জীবনে তিনি ঢাকাস্থ ড্যাফোডিল ইন্টারনেশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রনিক এন্ড কমিউনিকেশন বিভাগ থেকে  অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন৷

আবু সুফিয়ান রাহাতঃ ইব্রাহিম মুন্সির ছেলেদের তালিকা করলে যার নাম সবার উপরে থাকবে তিনি সাবেক স্কুল শিক্ষক মাওলানা ইউনুস সাহেব৷ তার কনিষ্ঠ সন্তান আবু সুফিয়ান রাহাত বাড়ির সকল তরুনের আইডল হিসেবে নিজেকে ঠিকভাবেই দাঁড় করাচ্ছেন৷ মাওলানা ইউনুস সাহেবের যোগ্য উত্তরসূরী সুফিয়ান বর্তমানে অগ্রনী ব্যাংক লিমিটেডের সিনিয়র অফিসার হিসেবের মানিকগন্জ জেলায় কর্মরত আছেন৷ অগ্রনীতে ব্যাংকে যোগ দেয়ার আগে তিনি সোনালী ব্যাংকের অফিসার আইটি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছিলেন৷ এরও আগে তিনি বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-এ খন্ডকালীন কাজ করেছেন৷ শিক্ষা জীবনে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স – মাস্টার্স এবং হাজিরহাট  উপকুল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন৷

নাজমুল হাসান প্রিন্সঃ ইব্রাহিম মুন্সি সাহেবের যোগ্য উত্তরসূরীদের একজন মরহুম আহম্মদ উল্লাহ। ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, মানুষের সাথে আচার আচরনে গাম্ভীর্য শরাফউদ্দীন (সারু) উনার কনিষ্ঠ ছেলে৷ উনার একমাত্র ছেলে নাজমুল হাসান প্রিন্স বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি সংস্থা ব্রাকে কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম জেলার লোহাগড়া উপজেলায়৷ এর আগে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ থেকে মাস্টার্স এবং নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এ অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা জীবনে তিনি বালুর চর ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং আলিম পাশ করেছেন৷

ইমাম হোসেনঃ মাদ্রাসা শিক্ষক পিতা মাওলানা মহিউদ্দিন ও মাতা নুরুন নাহার এর একমাত্র পুত্র সন্তান ইমাম হোসেন পেশায় একজন মাধ্যমিক  স্কুল শিক্ষক। শিক্ষকতার পাশাপাশি অবসর সময়ে তিনি ব্যবসায়ও মন দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন নিজের ছেলের নামে হামিম কম্পিউটার। এর আগে তিনি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাজিল ও কামিল পাস করে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন৷ শিক্ষকতার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও টান থাকায় ছুটে আসেন ভাঙ্গা ঘরে মানুষ গড়বেন বলে৷

তাবরীজ সাজ্জাদ সাজিবঃ শিক্ষাক্ষেত্রে সমানভাবে অবদান রাখা মানুষদের একজন তাবরিজ সাজ্জাদ সাজিব। ২০১৮ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিত বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী শেষ করেন৷ এর আগে তিনি আলেকজান্ডার সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও সরকারি উপকুল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেন৷

ইয়ামিন আবদুল্লাহ মাসুমঃ ইব্রাহিম মুন্সি’র উত্তরসুরীদের দীপ্তিময় পরিবার গুলোর একটি আহম্মদ উল্লাহ’র ছোট মেয়ে। সে ঘরের বড় ছেলে ইয়ামিন আবদুল্লাহ মাসুম বর্তমানে পড়াশুনা শেষ করে ইবনে সিনা ট্রাস্টে অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন৷ শিক্ষা জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, ঢাকাস্ত বাংলাদেশ রাইফেলস স্কুল এন্ড কলেজ এবং আদর্শ একাডেমি, ভোলায় পড়েছেন।

রুহুল আমিনঃ স্কুল পড়ার সময় আমাদের বিশালাকার বাড়ির রাস্তা ছিল খেলার মাঠ। আর ঐ মাঠে পেস বল করত রুহুল আমিন ভাই (স্বপন)। উনার বড় বড় চুল দেখে একবার শখ জাগছিল মাথার চুল বড় করব। কিন্তু আব্বার নির্দেশ অমান্য না করে চুল ছোটই রাখতে হয়েছে। রুহুল আমিন ভাই মরহুম গোলাম মোস্তফা (ফটিক মুন্সি) সাহেব এর মেজো ছেলে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিভিশন এর টেলিভিশন ইন্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন ঢাকাস্থ বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনে৷ এর আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিকস এন্ড ইলেকট্রিকাল ইন্জিনিয়ারিং এ অনার্স শেষ করেন। এরও আগে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, বিশ্বদরবার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা করেন৷

রিদওয়ান সোহাগঃ গ্রামের সকলের কাছে যখন বলতাম আমাদের মুন্সি বাড়ি। সবাই জিজ্ঞেস করত “ওহ আলাউদ্দিন স্যারদের বাড়ি! প্রায় সকলের প্রিয় এ স্যারের  জেষ্ঠ্য পুত্র রিদওয়ানুল ইসলাম সোহাগ পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বর্তমানে পদ্মাসেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ফেইজ টু (ভাঙ্গা-যশোর) এ কাজ করছেন। শিক্ষা জীবনে তিনি নোয়াখালী আইডিয়াল পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইন্জিনিয়ারিং শেষে বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি পড়ছেন৷ বর্ণাঢ্য শিক্ষা ও চাকুরীজীবন এর পাশাপাশি রাজনীতিতেও তার পদচারনা ছিল চোখে পড়ার মত। রামগতি রামগতি উপজেলায় সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মনোয়ারুল ইসলাম জয়ঃ নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রী শেষ করা তরুন এ গবেষক ইব্রাহিম মুন্সির নাতি স্কুল শিক্ষক ফিরোজ আলম সাহেবের বড় ছেলে। স্নাতকোত্তরে অধ্যায়নরত অবস্থাতে বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি কলেজে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন পাশাপাশি নানান সামাজিক কাজে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। রামগতিতে ভলান্টিয়ার ফর রামগতি নামে একটি দাতব্য সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা। গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন কোভিড-১৯ কুইক রেসপন্স এর সরকারি টিমেও।

আমিনুল ইসলাম বাবরঃ ইব্রাহিম মুন্সির বড় ছেলে আমিনুল্লাহ’র ছোট ছেলে গোলাম মোস্তফা ওরপে ফটিক মুন্সি সাহেব পেশায় একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন৷ সদা চুপচাপ থাকা মানুষটির ছোট ছেলে ও কনিষ্ঠ সন্তান আমিনুল ইসলাম ঢাকা পলিটেকনিক থেকে কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা ডিগ্রী নিয়ে বর্তমানে জাপান ভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়াইকেকে বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড এ ট্রেইনি ইন্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন৷ চাকরি জীবনের পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাকশন ইন্জিনিয়ারিং ( আইপিই) বিএসসি করছেন ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে৷ এর আগে তিনি চট্টগ্রামস্থ বিশ্ব দরবার মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দঃ বালুর চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাক্রমে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন৷ শিক্ষা জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই সে অনন্য নৈপুর্ণ্যতা দেখিয়েছেন। যার জন্য পেয়েছে সম্মাননাও।

আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি তরুনেরই কোন না কোনভাবে পৃথিবী পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা আছে। সবাই সমান তালে পৃথিবীকে বর্তমান পরিস্থিতিতে আনতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি সে সকল উদীয়মান তরুনদের কাছে যারা এ লিখায় আসার যোগ্য হওয়া সত্বেও আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা সকলকে আনতে পারিনি। সামনের কোন পর্বে সুযোগ এলে অবশ্যই এ নিয়ে আরো লিখবো। ইনশাআল্লাহ।

— লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী (ইংরেজি)

আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম