কোরবানীর ফ্রীজ এবং সভ্যতার পথ শিশু

নেইমপাম নেইমপাম

বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১০:৫৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩১, ২০২০

১.

জেলা শহরের একটি অভিজাত ইলেক্ট্রনিক্স দোকানের সামনে গ্লাসের বাহিরটায় বহুক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটি শিশু। বার তের বছর বয়েস হবে। দেখলেই বোঝা যায় পথ শিশুই হবে। বেশ কয়েকটা তালি দেয়া ছিন্ন ভিন্ন শাট গায়ে।পরনের জিন্স নামক প্যান্টটার অর্ধেকটাই নেই। অনেক্ষন ধরেই এ জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে শিশুটি। উতসুক পলকে বারবার তাকায় দোকানের ভেতরের দিকটায়।

কৌতুহল বসত একটু কাছে গিয়েই জানতে চাইলাম: কিরে এখানে দাঁড়িয়ে অমন ভাবে কি দেখছিস? খানিকটা হতবিহ্বল ছেলেটির জবাব, ফিরিজ কিনা দেখতাছি। এটা আবার দেখার কি হলো? আমার দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব না দিয়েই সে জানালো, সকাল থেকেই এখানে বেশ কয়েকবারই এসেছে। আরো জানায়, ব লোকেরা খালি ফিরিজ আর ফিরিজ কিনে। কয়টা কিনতে দেখলি?

– বহুত——!

০২

গরু হাটে ব্যাপক ভীড়। কুরবানীর ঈদের সময় বেশি বাকি নেই বলে গরু ক্রেতা ও বিক্রেতারও অভাব নেই। সবাই খুশি। অনেক বাচ্চা কাচ্চাও দেখলাম হাঁটে। ফুলের মালা নিয়ে এসেছে বাবার হাত ধরে। কুরবানীর জন্য কেনা গরুর গলায় পরাবে বলে। ব্যাপক বেচাকেনা। হৈ হুল্লোড়। মাঝারি সাইজের গরুই বেশি বেচা হচ্চে। অনেকের কাছেই জানতে চাইলামঃ সবাই নাকি একা একাই কুরবানী দেবে।

গরু বাজার থেকে ফেরার সময় মাঠের কোনে দেখতে পেলাম গতোকালের সে ছেলেটিকে। পোশাক আশাক আগেরটাই। ভাব খানাও সেটাই। ছেলেটির সাথে দ্বিতীয় বার দেখা হওয়াটা অপ্রত্যাশিতই ধরে নিলাম। কিন্তু কৌতুহল নামের প্যাঁচে আবারো আটকা পড়লাম। ছেলেটিকে কাছে ডাকলাম।

গরু হাটের মাঠে স্থাপিত একটি টং দোকানে গিয়ে ছেলিটিকে নিয়ে বসলাম। কেক খেতে দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম:

– কিরে তুই আজ আবার গরু হাঁটে?

– স্যার, গরু কেনা দেখতে আইছি!

-তো! কেমন দেখলি?

– বহুত গরু বেচা অইতেছে! মনে অয় দ্যাসের সব মানুষ ব লোক অই গেছে। সবাই একলা একলাই কোরবান দিবো।

০৩

পাশের বাসার আংটিরে দেখলাম বাসার ফ্রিজটা খালি করতেছে। আমাদের রাখা কেজি দুয়েক আপেলটাও ফেরত দিয়ে গেছে। এভাবে আরো কয়েক জনের রাখা জিনিস গুলোও ফেরত দিলেন। কিছুক্ষন পরে দেখলাম বারান্দায় শুকোতো দিচ্ছে ফ্রিজের বক্স গুলো। জোর করে মুখে হাসি রেখে ফ্রিজ খালি করার হেতুটা জানতে চাইলাম আন্টির কাছে। যা বলনেন উনি তার সারমর্ম হলো হলোঃ দু দিন পরেই ঈদ। এবার তারা একাই কুরবানী দেবেন। ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে গরুও কেনা হয়ে গেছে। তিনজন সদস্যের পরিবারে এতো মাংশ খাবে কে? তাই ফ্রিজ খালি করছেন তিনি।

হঠাত করে ছেলেটার হাতের গুতায় ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসলাম। ছেলেটাকে কেক খেতে দিয়ে এতোক্ষন ধরে আমি সকালে ঘটে যাওয়া আন্টির ফ্রিজ খালি করার দৃশ্যটি কল্পনায় ভাবছিলাম।

ভাবনায় ছেদ পড়ায় ছেলেটাকে ধমকের সুরেই বললাম, কিরে!! ছোট্ট এ কিরে শব্দটার জবাবে সে যে বাক্য গুলো আমাকে শোনাল তা শুনে মনের অজান্তেই নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম।

ফিরে আসার পথে ছেলেটির বলা কথা গুলোই বারবার মনে পড়ছে। আমি তার কথা গুলোই আওড়িয়ে যাচ্চি অবচেতন মনে।

ধনী লোক গুলো দেদারছে ফ্রিজ কিনছে। হাঁটেও গরু বেশ বেচা কেনা হচ্ছে। বেশির ভাগ লোকেই একা একা কোরবানী দেবে। বাসার ফ্রিজ গুলো খালি করছে গোস্ত রাখার জন্য। এখন মানুষ অনেক ধনী হয়েছে। কুরবানীও প্রচুর পরিমানে দিচ্ছে। কিন্তু কুরবানীর গোস্ত দান করা অনেক কমে গেছে। এখন আর কেউ গরীবদের মাঝে গোস্ত বিলায় না। সবার ফ্রিজে রাখে। সারা বছর খাবে বলে!!!! ধনীরা এখন ফকির হয়ে গেছে। প্রতি বেলায় তারা এখন ভালো মন্দ খেতে পারেনা! তাই কুরবানীর গোস্ত স্টক রাখে! নামেই কেবল কোরবানী দেয় সবাই। ধর্মীয় উদ্দেশ্য চাপা পড়ে যায় নতুন ফ্রিজ কেনার ধুমে!!!

…… নাহ! নাহ!! আমি আর ভাবতে পারছিনা। ছেলেটির আঞ্চলিকতা পুর্ন কথা গুলোর মর্মার্থ গুলোই আমার ভাবনায় কেবল উঁকি দিচ্ছে। অবশেষে মানতে বাধ্য হলাম। পথ শিশুটির কাছে আমার কিংবা আমাদের বিবেক পরাজিত। সত্যিই তো! পশু কোরবানী দিলেও আমরা আমাদের মনের পশুটাকে কুরবানী দিতে পারিনি এ সভ্য সমাজে এসেও। হায় মানবতা। ধিক্!!!