শিক্ষকদের নৈতিকতা ও সম্মান

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৭:০২ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৪, ২০২১

মারজান আক্তার: পত্র পত্রিকা এবং সোস্যাল সাইট গুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখা আমাকে এই লেখাটা লিখাচ্ছে- শিক্ষক এর সংজ্ঞায় আমি বলি, ‘শিক্ষক হলেন তিনি যিনি রাষ্ট্রের অবুঝ শিশু-কিশোরদের সঠিক জ্ঞানের প্রসারতা বাড়িয়ে তাদের সত্যিকারের একজন জ্ঞানী ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে রাখেন অন্যন্য ভূমিকা’। তাঁর এই ভূমিকার জন্যই তাঁকে সেই রাষ্ট্রের মানুষ গড়ার কারিগর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ইতিহাস বলে অতীত শিক্ষক আর বর্তমান শিক্ষক এর মধ্যে জ্ঞানগত ও গুনগত পার্থক্য অনেক বেশি। বর্তমান শিক্ষকরা নিজের চাওয়া পূরণ করতে শিক্ষার্থীদের যেভাবে ব্যবহার করছেন অতীত শিক্ষকরা ঠিক ততটাই শিক্ষর্থীদের কল্যাণে নিজের প্রাপ্যতা বিসর্জন দিয়েছেন। এই কারনে সেসব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছে হয়েছেন পরম শ্রদ্ধেয় ও অনুকরণীয়। এরকম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বর্তমান সময়ে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।

বাংলাদেশের শিক্ষক নিয়োগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তর অনুযায়ী চার স্তরে বিভক্ত যথাঃ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চতর ডিগ্রি । এই চার স্তরের শিক্ষক আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদা অনুযায়ী আবার চার ভাগে বিভক্ত যথাঃ সরকারি, ননএমপিও, এমপিওভুক্ত, বেসরকারি।

সরকারি ও এমপিওভুক্ত যারা তাঁরা তাদের পারিশ্রমিক অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রাপ্যতায় মোটেও তৃপ্ত নয়। সবাই যার যার জায়গা হতে সরকার কর্তৃক আরো বেশি সম্মানি পেয়ে আর্থ-সামাজিক পদমর্যাদা আরো উন্নত করে সমাজে সম্মান জনক ভাবে টিকে থাকতে চায়। কারন বর্তমান সময়ে বিশেষ করে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরকে রাষ্ট্র যেই সম্মানি দেয় তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে নূন্যতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করে সমাজে সম্মানজনকভাবে টিকে থাকা কোনভাবেই সম্ভবপর নয় । অর্থ্যাৎ এর মানে হলো রাষ্ট্র এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দিচ্ছে না।

যারা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন তারা যেনে শুনে আসছেন। আর যেনে শুনে না আসলে যখন এসেই যান তখন এ টাকায় আপনার পোষালে আপনি থাকতে পারেন। আর না পোষালে আপনি অন্য পেশায় চলে যেতে পারেন। কিন্তু না পোষালে এটা ছেড়ে না গিয়ে এখানে থেকে নিজের আর্থিক-শারীরিক-মানসিক তৃপ্তি মেটানোর জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করবেন, যত অনৈতিক কাজ আছে তা করতে থাকবেন আর আপনার জন্য ভালো শিক্ষকদের গায়ে কাদা লাগাবেন তা তো হতে পারে না? কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে এটাই হচ্ছে। কীভাবে দেখুন ২০১৪ সালে ১৩ই মার্চ প্রথম আলো একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির শিকার হয়। ইউকিপিডিয়া তে দেখা যায় বাংলাদেশের শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের উপর যৌন নির্যাতনের তালিকা যাতে তুলে ধরা হয়েছে ৫০ শতাংশ প্রাথমিকের শিক্ষার্থী, দুই তৃতীয়াংশ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ও উচ্চ শিক্ষার ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের নৈতিক আদর্শের মনে করে না। কেন মনে করছে না বুঝেন তো? কারন হিসেবে আমি বলব আপনারা শিক্ষার্থীদের সামনে ‘আপনাদের নৈতিকতা প্রদর্শনে ব্যার্থ হয়ে অনৈতিক কাজ গুলো তাদের সাথে করেন’ বলে।

প্রাথমিকের শিক্ষকরা সরকারি বেতন পান এখানের সবকিছু সরকারি অর্থায়নে চলে থাকে এবং বেশির ভাগ শিক্ষক মহিলা। এরপরও কোমলমতি এসব শিশুরা শিক্ষকদের কি এমন অনৈতিক কাজ বা ত্রুটি দেখতে পান যার কারনে শিশুদের মনে হয় এসব শিক্ষকরা নৈতিক আর্দশের নয়?

ননএমপিও ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি সম্মনিতে চলতে পারে না বিধায় অর্থ সংকট ও অনেক শিক্ষার্থীর ইচ্ছে পূরণে বাধ্য হয়ে প্রাইভেট, কোচিং এর সাথে সাথে অন্যান্য বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এসব শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সম্মানিত হওয়ার চেয়ে অসম্মানিত হয় সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার্থীদের যৌন হেনস্তা কম হয় এসব শিক্ষককদের দ্বারা। অথ্যাৎ শিক্ষার্থীদের সাথে আর্থিক লেনদেনের সংশ্লিষ্টতাই শিক্ষকদের অসম্মানিত হওয়ার মূল কারন।

৫ই মে ২০১৫ সালে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ তাদের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন শিক্ষকরাই যেখানে অপরাধী (পড়ার অনুরোধ রইল)। পুরো প্রতিবেদন পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। কেন? কারন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যৌন সুবিধা আদায়ের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করেন কিন্তু সেটা যে এতটা এটা আমার ধারণারও বাহিরে। প্রতিবেদনটা পড়ে মনে হয় এসব শিক্ষকরা কখনও শিক্ষক হওয়ারই যোগ্যতা রাখে নি, কে বা কারা এদের শিক্ষকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে ‘শিক্ষক শব্দটার সম্মানকে’ ধূলোয় মিশিয়ে দিল? সাথে সাথে মনে হলো একেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা ছোট বেলা হতে নিশ্চয়ই পড়াশোনায় ভালো, যাদের চিন্তা ও জ্ঞান অন্যদের তুলনায় সঠিকভাবে বিকশিত হয়েছে, সহপাঠী হিসেবে পেয়েছে উত্তমদের, পেয়েছে জ্ঞানী শিক্ষকদের সাহর্চয, বেড়ে উঠেছে বিশাল আঙ্গিনায়। তারা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হন তখন তারা দেশের সেরা বিদ্যাপিঠের শিক্ষক হন, দরিদ্র দেশের সর্বোচ্চ সুযোগও ভোগ করেন। তাদের তো মনোভাব, হৃদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মত বিশাল বড় হওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমরা একি দেখছি! কিভাবে তৈরি হলো এদের এই যেনা-ব্যভিচার করার মত ঘৃণ্য ও নোংরা মনোভাব? কি করে তার আচরণ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়? এই ঘৃণ্য ও নোংরা মনোভাব যুক্তদের কেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো? কেন এদের এই ঘৃন্য নোংরা মনোভাবের জন্য শিক্ষকতার মহান পেশা হতে বহিষ্কার করা হয় না? এদের এই যেনা-ব্যভিচার (ঘৃন্য, নোংরা মনোভাব) ঠেকিয়ে দেয়ার কি দুনিয়ায় কেউউ নেই?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকার ‘সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকে’ বলে এদের অর্থের অভাব হয় না তাই এনারা যেই ‘যেনা-ব্যভিচার করেন’ তা অর্থের জন্য করেন না শুধু মাত্র ওনাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত মনোরঞ্জনের জন্যই করেন। এটা যদি হয় শিক্ষকের চরিত্র তাহলে কোন সুস্থ বিবেক শিক্ষকদের সম্মান করবে? আপনারাই বলেন। শিক্ষক হয়ে আপনি নিজেই যখন আপনার সম্মান রাখতে পারেন না অনৈতিক কাজ করে চলেন তখন আপনি শিক্ষক হলেও অন্য জন আপনাকে অসম্মানিত করারই সঠিক ও শ্রেয়।

২০১৮ সালের ১২ই এপ্রিল দৈনিক যুগান্তর লিখেছে শিক্ষকরা নিজেদের কারনেই সম্মান ধরে রাখতে পারছেনা। কারন কিছু শিক্ষকরা শিক্ষকতা পেশাকে ব্যবসা মনে করে যা করতে ইচ্ছে করছে তাই করছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে (এর জন্য রাষ্ট্র দায়ী কীভাবে তা আগেই লিখিছি), কিছু শিক্ষক যৌনতার সুখ মেটাচ্ছে, কিছু শিক্ষক গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি করছে(কেউ যখন স্বীকৃতি গবেষক হয়ে যান গবেষণা করা না করার তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে তবে কেন কোন গবেষক অসম প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে নৈতিক স্খলন ঘটান বা প্লেজিয়ারিজমে এর আশ্রয় নিয়ে থাকেন আমার বোধগম্য নয়), কিছু শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করছেন তো আর কয়জন ভালো ভালো শিক্ষক থাকে হিসাব করেন? সবাই উত্তর পেয়ে যাবেন কেন শিক্ষকরা সম্মান না পেয়ে অস্মানিত হন। দেখুন ‘রাষ্ট্র যেসব শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানি দিচ্ছেন না তারা করছেন অর্থের জন্য শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করে আর যেসব শিক্ষকদের রাষ্ট্র উপযুক্ত সম্মানি দিচ্ছেন তারা তাদের অতিরিক্ত, অনৈতিক জৈবিক চাওয়া পূরণের জন্য শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করছেন। বাহ! শিক্ষক সমাজ বাহ!….

যে সমস্ত শিক্ষকরা অর্থের জন্য নিজের সম্মান রাখতে পারছেনা বা শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করছেন তাদের জন্য রাষ্ট্র উপযুক্ত সম্মানির ব্যবস্থা করলে এটা সমাধান হয়ে যায়। রাষ্ট্র হতে উপযুক্ত সম্মানি পাওয়ার পর ও যদি কেউ তা করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কোন ত্রুটি না করা। যারা জৈবিক চাওয়া পূরণের জন্য করে তাদের অন্যায় আচরণের অভিযোগ নির্ভয়ে শিক্ষার্থীদের করতে দেয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা এবং অন্যায় আচরণকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে কোন ত্রুটি বা দেরি না করা।

যে সমস্ত শিক্ষকগণ দুটোর একটাতে নাই তাঁরা অবশ্যই সম্মানিত এতে সন্দেহ প্রকাশের কোন সুযোগ নেই। তবে তাঁরা কোন চক্রান্তের শিকার হয়ে দুনিয়ায় অসম্মানিত হলেও তাঁদের দ্বোজাহানের সম্মানের জিম্মাদার আল্লাহ নিজেই।

শিক্ষক তিনি যে স্তরেরই হোন না কেন যদি তার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার্থীদের শারিরীক, মানসিক নির্যাতন বা হেনস্তা করে এবং তা আদায় করে নেয় তাহলে সেই শিক্ষক কি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে? যে শিক্ষক হওয়ারই যোগ্যতাই রাখে না তাকে কেন শিক্ষকতার মত পবিত্র পেশায় সম্মানের সাথে বসিয়ে রাখা হয়? কেন শিক্ষকতা পেশা হতে বের করে দেয়া হয় না বলতে পারেন? কেন তাদের তোয়াজ করে পবিত্র অঙ্গনে রাখা হয়? কারা এদের তোয়াজ করে? এদের তোয়াজ করা কি কোনদিনই বন্ধ হবে না? যত দিন না হবে ততদিন শিক্ষক তার আচরণ ও চরিত্রের কারনে অসম্মানিত হবেন আর এ অসম্মানটা আল্লাহর তরফ হতে আসে, আসবে ঠেকাবে কে?

 

–লেখক: ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী ও এমফিল গবেষক

নোয়াখালী