নারীর শিক্ষা ও গৃহস্থালির কর্মের মূল্যায়ন

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৫:৩৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০২১

মারজান আক্তার: নারীরা অর্থ উপার্জনের জ্ঞান অর্জন করলে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই চাকরি করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আর কেউ তা করতেও পারে না কারন ইসলামে নারীর জ্ঞান অর্জনের নিষেধজ্ঞা নেই কিন্তু নারীরদের ঘরে থাকার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে , এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আর তোমার নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না (সুরা আযাব : আয়াত ৩৩)”। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন নবী আপনি মুমিন নারীদেরকে বলুন, “তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। তারা যেন সাধারণত যা প্রকাশ থাকে তা ছাড়া স্বীয় কেশবিন্যাস প্রদর্শন না করে, মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে। অল্প সংখ্যক পুরুষ স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, স্ত্রী লোকের অধিভুক্ত বাঁদী, যৌন কামনা-রহিত পুরুষ ও সে সব বালকদের যারা নারীর গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের সাথে ছাড়া অন্য কোন পুরুষের সাথে দেখা না করে(সুরা নিসা: আয়াত ৩১)”। গৃহে (ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করবে ধারন ও লালন করবে এবং পারিবারিক কাজ সম্পন্ন করবে) আল্লাহর নিদর্শনা অনুযায়ী অবস্থান ও কাজ করা নারীর জন্য ইবাদত স্বরুপ।

এজন্যই নারী প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষিত হলেই চাকরি করতেই হবে এমন ধারনা ভুল। নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নারীদের কুসংস্কার মুক্ত করা ও তাদের মধ্যে উন্নত বিবেকবোধ জাগ্রত করা, একটা শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করা ইত্যাদি ইত্যাদি । তাই কুসংস্কার মুক্ত হতে, শিক্ষিত জাতি গড়তে, কল্যাণমূলক কাজ করতে চাকরি করাই লাগবে এ কথা কে বলেছে? মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে চাকরির প্রয়োজন নেই বা চাকরি ছাড়া সেটা যেকোনো ভাবেই বিশেষত পারিবারিক কর্ম বা গৃহের কর্ম যথাযথ ভাবে সম্পন্নকরণের মাধ্যমেও হতে পারে। নারী উচ্চ শিক্ষিত হলেই ফরজ তরক করে চাকরিই করতে হবে এমনটা আমরা কেন ভাবছি (চাকরি করতে চাওয়ায় ঢাবি ছাত্রীকে হত্যা ২২ জুন ২০২০ বাংলার ইনসাইডার) যে ভাবনার জন্য সংসার ভেঙ্গে যাবে, সংসারে শান্তির বদলে অশান্তি তৈরি হবে, জীবন দিতে হবে। বলছি জীবনসঙ্গী ভালো হলে এমন ভাবনা না ভাবাই নারীর জন্য উত্তম নয় কি?

প্রযুক্তির যুগ তথা আধুনিক যুগে এসে পড়াশোনা করা অনেক মেয়েরা চাকরি করাটাকে ফরজ বলে মনে করছে। তাদের জন্য বলছি ফরজটা মনে করতে হবে আবশ্যকীয়তা বা প্রয়োজনীয়তা অনুসারে। কেননা ইসলাম নারীর জন্য যেরকম করে ইবাদত, পর্দা করা ফরজ করেছে বর্তমানে চাকরির জায়গাগুলোতে সেরকম করে পর্দা মেনন্টেইন করা ইচ্ছা থাকলেও অনেক কঠিন আর ইচ্ছে না থাকলে তো সেই রকম ব্যবস্থা নাইই বলা চলে । এছাড়া ইসলামে যে জ্ঞান অর্জন করা ফরজ বলা হয়েছে (ইসলামের জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে) বাস্তবতায় সেই ইসলামের জ্ঞান অর্জন বাদ দিয়ে জীবন ও জীবিকার প্রয়োজন বা অতিরিক্ত প্রয়োজন মেটাতে ‘অর্থ উপার্জনের সাথে’ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের হিড়িক বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে যা আল্লাহ তায়ালা নারীকে করতেও বলেননি । তাই বলছিলাম জীবনে যদি ‘উত্তম জীবনসঙ্গী’ আল্লাহ মিলেয়ে দেন তাহলে চাকরির পিছে না ছুটে গৃহে থেকে ইবাদত ও পর্দার মাধ্যমে সন্তান, নিজ ও স্বামী সংশ্লিষ্ট আত্নীয়-স্বজনদের সেবার মধ্য দিয়ে জীবন পার করে দেয়া সবচেয়ে উত্তম কেননা নারীদের আল্লাহ তায়ালা এটাই করতে নারীকে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা করলে নারীর জন্য আল্লাহ কর্তৃক ফরজ ও সুন্নত কাজগুলো যথাযথ ও সুন্দর ভাবে আদায় করে দুনিয়া ও আখিরাতে শান্তিময় জীবনের অধিকারি হওয়া অনেক সহজ।

সমাজে দেখা যায় যদি স্বামীর সাথে নারীকে থাকতে হয় বা থাকে তাহলে নারীকে অবশ্যই উভয় দিকের স্বজনদের(পরিবারের সকলেরসহ) প্রাপ্য সেবা নিশ্চিত করতে হয় ও আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ কাজগুলোও প্রতিদিনই করতে হয় চাকরী করলে দুটো যথাযথভাবে সমপন্ন করা এতটাই কঠিন যা সকল নারীর পক্ষে পারাও অসম্ভব আর এগুলো করতে প্রতিদিনই ৭-১০ ঘন্টা সময় শ্রম দিতে হয়। এই শ্রম দেয়াটা অবশ্যই কল্যাণমূলক কাজ। যদিও আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে নারী স্বামীর গৃহে বাস করলে স্বামীর পরিবার ও স্বজন বেশি সেবা পায় তাই সকলের সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে নারীকে বাধ্য হয়েই ঘরের কাজে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়। তবে কোন নারীর জীবনে উত্তম জীবনসঙ্গী না জোটে বা বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে নারীর চাকরির করা ফরজ হয়ে পড়ে (তবে নারীকে চাকরি এমনভাবে করতে হবে যাতে নারীর জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরজগুলো ও সুন্নত কাজগুলো তরক না হয়) তখনও নারীকে ঘরের অনেক কাজ করতে হয় সাথে বাহিরেরটাও। বাহিরের কাজ অর্থ মুল্যে মূল্যায়িত হলেও ঘরের কাজ অর্থমূল্যে তো দূরে থাক কাজ বলেও মূল্যায়িত হয় না।

বলছিলাম একজন নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক বা না হোক আল্লাহর নির্দেশ মানতে ও পরিবার প্রথা টিকিয়ে রাখতে এমনকি পরিবারের সকলের সেবা নিশ্চিত করতে তাকে ঘরে থাকতেই হয়, হচ্ছে (গৃহের কাজে ৪৩ শতাংশ নারীর কাজ পুরুষের কাজ ১ শতাংশ. প্রথম আলো, ২০-২-২০) । নারীর ঘরে থাকার কারনেই পরিবার হচ্ছে, সমাজ, রাষ্ট্র টিকে আছে তা ই নয় বরং সুন্দর ভাবে সচলও রয়েছে রাষ্ট্র। তো যারা পরিবার, পরিবারের শান্তি এমনকি রাষ্ট্র টিকেয়ে রাখতে পরিবারে প্রতিদিন ৭-১০ ঘন্টার অধিক শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন (যারা দেয়না তারা এর আওতায় আসবে না) তাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলা হচ্ছে, হয় কেন? নারী যদি পরিবারে না থাকে তাহলে কি পরিবার বলে কিছু থাকবে? থাকবে সমাজ? থাকবে রাষ্ট্র? থাকবে না তাহলে কেন নারীর ঘরে থেকে পরিশ্রম করাটাকে কোন মূল্যায়ন করা হয় না? কেন পরিবারে এতটা সময় কাজ করার পরও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথা শুনতে হয়? একি সময় ঘরে না দিয়ে বাহিরে দিলে যদি তা অর্থ মূল্যে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে একি সময় ঘরে দিলে তা কেন অর্থ মূল্যে মূল্যায়ন হয় না? মূল্যায়ন তো সুন্দর ও অর্থমূল্যে করা উচিত আর তা পরিবার প্রধান ও রাষ্ট্রেরই করা উচিত, আপনারা বলেন উচিত নয় কি ?

একজন নারী উচ্চ শিক্ষিত হোক বা অল্প শিক্ষিত বা শিক্ষিত নাই হোক বিয়ের পর তার জন্য সংসার করা ফরজ আমাদের সমাজ-বাস্তবতায়। তো সংসারী হয়ে গেলে পরিবারের সম্পূর্ণ দেখবাল তাকেই করতে হয় “যা থেকে সে চাইলেও বের হয়ে আসতে পারে না” আর এতে তার দৈনিক সময় ব্যয় করতে হয় ৭-১০ ঘন্টা। যদিও বর্তমান সময়ে কিছুটা পরিবর্তন আসছে তারপরও অধিকাংশ নারীর পরিচয় সে সকালে উঠে অন্য সবার আগে তার ঘুমাতে যাওয়া সবার পরে কেননা সংসার ঘুচিয়ে রাখার পুরো দায়িত্ব যে তার কাঁধে আর সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে প্রতিদিন সাত-দশ ঘন্টারও বেশি কাজ করে থাকে। নারী যদি এভাবে পরিবারে সময় দিয়ে কাজ না করত তাহলে যে পরিবারকে কেন্দ্র করে যে সমাজ, রাষ্ট্র চলছে তা টিকে থাকত না।

আপনারা একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন একজন নারী যখন চাকরি করে তখন তাকে আগে তার সংসারের সমস্ত কাজ ঘুচিয়ে তার কর্মে যেতে হয়। সেই কর্ম শেষ করে যখন ঘরে ফিরে আসে তখন তাকে আবার তার ঘরের কর্মে ঢুকে দিনের বাকি কাজ শেষ করতে হয় সেটা যত রাতই লাগুক না কেন। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তা একবারে ভিন্ন তিনি যদি চাকরিজীবি হোন তাহলে ঘরে ফিরে আসার পর বা চাকরিতে যাওয়ার আগে ওনার কোন কাজ থাকে না বরং ওনার কি লাগবে সেটাও রেডি করে সামনে রাখতে হয়। এটা ওনাদের প্রাপ্যতা যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজে চলে আসছে বলে নিরবে নারী তা করে যাচ্ছে। চাকরি না করলেও ওনাদের সংসারে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র এনে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকে না।

পুরুষদের কাজ নিয়ে আমি কথা বলছিনা কথা বলছি নারীর কাজ নিয়ে। ‘গৃহিণী একটা পেশা’ যা আমরা পেশা হিসেবে লিখে থাকি। গৃহিনি যদি পেশা হয় তাহলে তা অবশ্যই শ্রমের আওতায় আর শ্রম মানে মজুরি বা পারিশ্রমিক। কিন্তু আমাদের দেশে “গৃহিণী পেশা হলেও এই পেশার মূল্য আমাদের দেশের পুরুষদের, রাষ্ট্রের কাছে একেবারে মূল্যহীন”। সারাদিন সংসারের জন্য খেটে যখন নারীকে খারাপ বাক্যসহ শুনতে হয় ‘ঘরে তো থাক কি কাজ কর’? ‘ঘরেরই তো থাক কি কর? তখনই এ কথা বলতে হয় ‘গৃহিণীর ঘরে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করার মূল্য কোথায়’?

নারীর কাজের বা শ্রমের এই অবমূল্যায়ন আজকের বা কালকের নয়, বলা যায় এটা আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার ট্রেডিশন। আমার দাদা, বাবা এভাবে করে এসেছে আমিও করছি আর এই করতে করতে আজকের দিন। এই ধারাবাহিকতা পরিবর্তনের সময় এসেছে নারী বাহিরে কাজ না করে সে সময় ঘরের কাজ করলে তাদের কাজের ন্যয্য স্বীকৃতি ও সেটাকে শ্রম হিসেবে মূল্যায়ন করার। অর্থ্যাৎ নারী কাজ ঘরে করুক আর বাহিরে করুক সেটাকে কাজ বা শ্রম হিসেবে মূল্যায়ন করে ন্যয্য পারিশ্রমিক বা মজুরি নিশ্চিত করার। আর এটা রাষ্ট্রকেই করতে হবে কেননা যুগ যুগ ধরে নারীর গৃহস্থালির কাজ রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে ও সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। তাই নীতিমালা তৈরি করে নারীর গৃহস্থালির কাজকে যথাযথ ও অর্থমূল্যে মূল্যায়ন করা এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

অর্থ্যাৎ আমি বলতে চাচ্ছি “নারী গৃহে থাকবে, গৃহের কাজই করবে আল্লাহর হুকুম মানতে এবং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে। আর নারীর গৃহ কর্মকে শ্রম হিসেবে গণ্য করে যথাযথ সম্মান প্রদশর্ন করবে পরিবার প্রধান, সমাজ এবং এই শ্রমের অর্থ মূল্য, স্বীকৃতি দিবে রাষ্ট্র”। গৃহীনি পেশা সেটার সম্মান সমুন্নত হবে।

লেখক: ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী এবং এফিল গবেষক ও বেসরকারি শিক্ষক