শিক্ষকদের বাকরুদ্ধতা

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৬:১৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৯, ২০২০

মারজাহান আক্তার: একজন শিক্ষককে বলা সেই ‘দেশের মানুষ গড়ার কারিগর’ অর্থ্যাৎ তিনারা সেই দেশের কোমলমতি শিশুদেরকে উপযুক্ত শিক্ষাদান করে জ্ঞানী-বিজ্ঞ করে গড়ে তুলবেন যাতে তারা দেশের জন্য উপযোগী হয়ে ভবিষ্যৎ এ দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিবে এবং পাশাপাশি তারা বিশ্ব মানেরও উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠবে। আর এই কোমলমতি শিশুদের দেশ-বিদেশের উপযোগী করে তোলার জন্য যারা কাজ করছেন তাদের দুটো বৃহত্তর শ্রেণী রয়েছে। আর এই বৃহত্তর শ্রেণীর মানুষগুলো হল বেসরকারি তথা এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও নন এমপিও শিক্ষক(এমপিও পাবার অপেক্ষায়) যারা রাষ্ট্র কর্তৃক এক ধরনের শ্রম শোষণের শিকার।

শ্রম শোষণটা কি? শ্রম শোষণ হল শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করিয়ে সেই কাজের ন্যায্য পারিশ্রমিক না দেয়া। আল্লাহ্ শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রাপ্য না দেয়াকে পাপ করা বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “কেয়ামতের দিন আমি তিন লোকের বাদী হব যার একটা হল যেলোক শ্রমিক নিয়োগ করে পূর্ণ কাজ আদায় করে নিয়েছে কিন্তু তার প্রাপ্য মজুরী প্রদান করেনি (বুখারি-২২২৮)”। আমাদের স্বল্পউন্নত দেশে ব্যক্তি মালিকানায় শ্রম শোষণের মূল কারণ ব্যক্তিগত স্বার্থ। যেটাকে আমরা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ব্যক্তিমালিকানার সাথে তুলনা করতে পারি। একটি দেশের বসবাসরত সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা নিজের কল্যাণের জন্য বা রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজ নিজ জায়গা হতে কাজ করে সেটাকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক শ্রমও বলা যায় ব্যক্তির শ্রমের কল্যাণে একটি দরিদ্র দেশ উন্নত দেশে পরিণত হয়।

পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মালিক শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে পুঁজিপতিতে পরিণত হয় কিন্তু আমি এটা বুঝিনা একটা রাষ্ট্র কেন বেসরকারি শিক্ষক ও এমপিও ভুক্তির অপেক্ষায় থাকা শিক্ষকদের সাথে এমন কাজ করছে? রাষ্ট্র কি নিজেকে পুঁজিপতি মনে করছে? রাষ্ট্রের পুঁজিপতি বনে যাওয়ার মত কি কোন স্বার্থ আছে? যদি থাকলে সেটা কি? রাষ্ট্রের কি দেশের উপযোগী ও বিশ্ব মানের শিক্ষার্থী গড়ার কোন ইচ্ছে নেই? কেন বলছি? বলছি এই জন্য যে, যেখানে একটা দরিদ্র দেশকে উন্নত করতে প্রধান ভূমিকা রেখে চলে সেই দেশের শিক্ষা। যারা শিক্ষা দিয়ে থাকেন তারা শিক্ষক। আমার দেশ তথা বাংলাদেশের এই শিক্ষকরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ৯৭%(অন্যদৃষ্টি.৩১ জুলাই, ২০১৮) হল বেসরকারি আর সরকারি হল ৩%। ৯৭% বেসরকারি শিক্ষকরা সরকার কর্তৃক বেতন পায় না যেটা পায় তা হলো অনুদান যা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সম্মানজনক ভাবে চলা তো দূরে থাক কোন মতে ডাল-ভাত খেয়ে পরিবার চালিয়ে নেয়াও বেশ কষ্ট সাধ্য ব্যাপার।

একজন বেসরকারি শিক্ষক ও নন এমপিও শিক্ষক যার কাছে তার পরিবার পর্যাপ্ত মৌলিক চাহিদা চাহিলে না দিয়ে বা না পূরণ করে বা জবাব না দিয়ে বাকরুদ্ধ থাকতে বাধ্য হন কারন তিনি একজন বেসরকারি শিক্ষক নয়ত এমপিও ভুক্ত হওয়ার অপেক্ষমান শিক্ষক। তাঁর পক্ষে কোনভাবেই সেই পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না তখন পরিবার লাঞ্চনা, গঞ্জনা সহ্য করে তাকে থাকতে হয় পরিবার যাকে আমি পরিবারের কাছে ঐ শিক্ষকের বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা বলব। কারন বাকরুদ্ধ হয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকে না।

একই ভাবে সমাজে বাস করতে গিয়ে দেখা যায় একজন দৈনিক শ্রমিক ও ছোট ব্যবসায়ীর পারিশ্রমিক বর্তমান বাজার মূল্যে একজন বেসরকারি শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি। একজন বেসরকারি শিক্ষকের চেয়ে তারা যখন ভালো ভাবে জীবন যাপন করে তখন শিক্ষক ও তাঁর পরিবার মানসিক, সামাজিক ভাবে সমাজের ঐ সব ও অন্যন্য স্বাবলম্বী পরিবারের কাছে ছোট হয়ে থাকতে হয় যেটাকে আমি শিক্ষকের সামাজিক বাকরুদ্ধতা বলব।

এছাড়া একজন বেসরকারি শিক্ষক নানা শর্তাবলি মেনে নিয়ে শিক্ষক হন বা তাঁর দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এসব শর্তের কারণে শিক্ষকরা চাইলে নিজের স্বাধীন ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে না তাঁকে সরকারের বাঁধা নিয়মে চলতে হয়। শিক্ষক ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছায় হোক বাকরুদ্ধ থাকতে বাধ্য হন অস্মানীত, হেনস্তা, হয়রানি হতে বাঁচতে ও চাকরী হারনো হতে বিরত থাকতে যেটাকে আমি রাষ্ট্রীয় ভাবে বাকরূদ্ধ করে দেয়া বলব।

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই বলতে হয় যেখানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শিক্ষা র্থীরা প্রায় ৯৭% শিক্ষার্থী বেসরকারি মাধ্যমিক ও বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে পাঠদান শেষ করে এবং শিক্ষার এই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর হচ্ছে উচ্চ শিক্ষার সোপান, সোপান তৈরি করা মানুষগুলোর বৃহৎ অংশই বেসরকারি কিন্তু কেন? অর্থ্যাৎ বাংলাদেশে শিক্ষার বেসরকারি ব্যবস্থাপনা এত বেশি কেন? খুবই লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতন সাড়ে বার হাজার এর মতো যা দিয়ে তিনি তার সংসার চালান। বর্তমানে এসব শিক্ষকরা বেশির ভাগই উচ্চ শিক্ষিত। রাষ্ট্র কর্তৃক একজন উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকের জন্য অল্প বেতন নির্ধারন কি শ্রম শোষণ নয়? রাষ্ট্র কেন এরকম উচ্চ শিক্ষিত বেসরকারি শিক্ষকের শ্রম শোষণ করছেন তা আমার বোধগম্য নয়। এইজন্য বলছি যার নুন আনতে পানতা পুরায় তাঁকে দিয়ে রাষ্ট্র যদি মনে করেন অনেক ভালো ফল পেয়ে যাবেন তবে সেটা কি গুড়ে বালি হবে না? পেটে না দিলে পিঠে সয় না। যদি শিক্ষক হিসেবে তার পরিবার না থাকত, নিজের পেট না থাকত তবে তিনি শুধু মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে জীবন ভর কাজ করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবতা তো তা নয় সেটা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেন তাই না? শিক্ষকদের অনাহারে অর্ধহারে রেখে তাঁদের কাছ থেকে বিশ্ব মানের শিক্ষা ও শিক্ষার্থী আশা করা একটা রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাকর নয় কি?

শিক্ষাকে একটি দেশের বা জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। তাই ‘শিক্ষক’ হল সেই মেরুদণ্ডের প্রাণ। সেই প্রাণই যদি সতেজ না থেকে লাঞ্চিত-বঞ্চিত-অবহেলিত হয় তাহলে তাঁদের দ্বারা কি করে আরো সতেজ প্রাণের ফুল ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে? যে ফুল সুরভি ছড়াবে শুধু দেশের সীমায় নয় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব আঙ্গিনায় সেই ফুলকে তো সেরকম করেই ফোটানোর ব্যবস্থা করতে হবে না কি? আর সেই দায়িত্ব তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে তাই না? না ঠিক বলিনি?

বলছিলাম ৯৭% বেসরকারি শিক্ষক ও এমপিও ভুক্তির অপেক্ষায় থাকা শিক্ষকদের কথা। বেসরকারি শিক্ষকরা কম বা বেশি যেটাই হোক করনা কালীন সময়ে অনুদান পেয়ে আসছে। আর যারা এমপিওভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে এই করনা কালীন সময় এদের ‘অর্থ কষ্ট’ গুলো চোখের পানি ধরে না রাখার মত নয়। যেগুলো কোন বিবেকবান মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়, একজন শিক্ষক গলায় চাইন বোর্ড ঝুলিয়ে অর্থের জন্য সাধারণ জনগণের কাছে দু হাত বাড়িয়ে রাখছে মানুষ তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করছে এই লজ্জা কি তাঁর নাকি রাষ্ট্রের? যে দেশে শিক্ষকদের অর্থ কষ্ট মেটাতে ভিক্ষা করতে হয়, অন্য কাজ করতে হয় সে দেশে শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্তটা অনেক বড় ভুল নয় কি? যেই রাষ্ট্র শিক্ষকদের অর্থ কষ্ট দুর করে তাঁদের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে দেশ-বিদেশের উপযোগী করে শিক্ষার্থী গড়ার সুযোগ করে না দিয়ে ভিক্ষার জন্য রাস্তায় নামিয়ে দেয় সেই রাষ্ট্র কি করে ভাবে তার রাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের হয়ে নিজ দেশের জন্য উপযুক্ত হবে ও বিশ্ব দরবার হতে সম্মান ভয়ে আনবে? আমি বলছি শিক্ষকদের এই শ্রম শোষণ বন্ধ না হলে, রাষ্ট্র এ সব বেসরকারি ও নন এমপিও শিক্ষকদের দিকে সুদৃষ্টি না দিলে নিজ রাষ্ট্রের ও বিশ্বমানের উপযোগী শিক্ষার্থী যেমন বের হয়ে আসবে না তেমনি শিক্ষা দিয়ে একটি রাষ্ট্র উন্নত হওয়ার যে সুযোগ তা কখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। পেটের খুদায় মুখও বন্ধ রাখা যায় কিন্তু পেটের প্রয়োজনীয় আহার না দিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। বেঁচে থাকতে হলে আগে পেটের প্রয়োজনীয় জিনিস দিতে হবে যেখান হতে পার যেভাবে পার । শিক্ষকদের ‘অর্থ কষ্টের’ কারনে বোবাকান্না, বাকরুদ্ধতা, লজ্জায় কারোর কাছে বলতে না পারা, ভিক্ষার জন্য হাত পাতা এর জন্য কি রাষ্ট্র দায়ী নয়? বাংলাদেশে রাষ্ট্রের ও সরকারের সুদৃষ্টি ছাড়া এসব শিক্ষকদের জন্য কারোর কিছু করারও থাকে না।

আমি বলতে চাই শিক্ষকদেরকে পরিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ভাবে বাকরুদ্ধ করে দেয়ার দায় কার বা কে নিবে? নাকি যুগ যুগ ধরে যেভাবে চলে আসছে সেভাবেই চলবে। সময়ের সাথে সকল কিছুর পরিবর্তন হলেও শিক্ষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন অপরিবর্তিতই থেকে যাবে? আর এতে রাষ্ট্র খুশি হবে তাই না? কারন তাকে পুঁজি পতি বনতে হবে তো

-লেখক

ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী এবং এমফিল গবেষক

দেশালোক ডটকমের নিয়মিত লেখক