করোনা কাল ও বেসরকারি স্কুল শিক্ষকদের বোবা কান্না

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৭:৩৮ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ৬, ২০২০

মো: আইউব খান: ওলা বিবি,বসন্ত বিবি আর যক্ষা বিবি।ওরা ছিল তিন বোন এক প্রাণ। যেখানে যেতো এক সঙ্গে যেতো ওরা। কাউকে ফেলে কেউ বেরুতো না বাইরে। যে অঞ্চলে একবার হানা দিতো সেই অঞ্চল অনেকটাই জনশূন্য করে দিতো। হাজার বছর ধরে উপন্যাসে লেখক জহির রায়হান এভাবেই বর্ণনা করেছেন প্রাণঘাতী কলেরা, বসন্ত ও যক্ষা রোগের বর্ণনা।

তবে এ যুগের জহির রায়হানরা লিখবে ওরা ছিল চারবোন। নতুন করে জন্ম নিলো করোনা বিবি।চীনের উহান প্রদেশ থেবে শুরু করে বর্তমানে পুরো বিশ্বকে নাজেহাল করে দিয়েছে নোভেল করোনা ভাইরাস। চীনা কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী প্রথম এই ভাইরাস ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে। কিন্তু চীনের গবেষকদের একটি জরিপ বলছে ১ ডিসেম্বর এটি ধরা পড়ে। অপরদিকে হার্ভাড এর একটি জরিপ বলছে আগস্টের শুরু থেকেই উহানবাসীদের মধ্যে করোনার লক্ষণগুলো বিদ্যমান ছিল।যেটাই হোক না কেন মাত্র ১ বছরের ও কম সময়ের মধ্যে বিশ্ববাসী দেখল এর ভয়ানক রূপ।সর্বশেষ তথ্যমতে সারা বিশ্বে প্রায় চার কোটি নব্বই লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে যার মধ্যে বারো লাখ উনচল্লিশ হাজারের মতো মারা গেছেন।

বাংলাদেশে ৮ ই মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। তারপর মাত্র আট মাসে চার লাখ ষোলো হাজার ছয়জন আক্রান্ত হয়, যাদের মধ্যে ছয় হাজার একুশ জন মারা যান (গতকাল পর্যন্ত)। সংক্রমন ঠেকাতে সরকার ১৬ ই মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং ২৬ ই মার্চ থেকে সারাদেশ লকডাউন ঘোষণা করে। পরবর্তীতে সীমিত আকারে লকডাউন উঠিয়ে নিলে এখন মোটামুটি সবকিছুই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে সবাই মরিয়া। লকডাউনকালীন সময়ে রপ্তানিমুখী শিল্পকে বাঁচাতে সরকার ১ লাখ ১২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। এখনো দেড় হাজারের অধিক দৈনিক আক্রান্ত হবার ফলে স্বাস্থ ঝুঁকি বিবেচনা করে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। গত ১২ ই জুলাই থেকে শর্তসাপেক্ষে হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও হিফজখানা চালু করেছে। এইচএসসি তে অটো প্রমোশন দিলে ও মাধ্যমিকে অ্যাসাইনমেন্ট ভিত্তিক মূল্যায়নের কাজ শুরু করছে। প্রাধমিকে এখনো কোনো নির্দেশনা নেই।অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা। তাই প্রাথমিকে ভালো কোনো সিদ্ধান্তের অপেক্ষা।

পরিসংখ্যান বলছে দেশে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী। যার মধ্যে প্রায় ২ কোটি প্রাথমিকে।যাদের একটা বৃহৎ অংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ে।পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশে প্রায় ৬০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন স্বুলে ৬ লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি স্বুল ও কলেজ। আবাসন খরচ ও শিক্ষকদের বেতনের কারনে অনেকগুলো দেউলিয়া হওয়ার পথে। অন্যান্য সবখানে যখন কর্মযজ্ঞ তখন এখানে শুধু নিরবতা।তাই, অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়ে হলে ও প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের বাঁচাতে সরকারের এগিয়ে আসা দরকার। অর্থনৈতিকভাবে দেশ এখন এগিয়ে। দ্যা ইকোনমিস্টের গবেষণামূলক এক প্রতিবেদনে ৪ টি মানদন্ডের ভিত্তিতে উদীয়মান অর্থনীতির ৬৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৯ম তম।সেই দেশে শিক্ষকেরা এত কষ্টে কেনো থাকবে। অনেকে বিভিন্ন পেশায় চলে গেছে।আবার অনেকে কোনো কর্মের সংস্থান না করতে পেরে দুঃসময় পার করছে।

২০১৯ সালের শিক্ষক মঙ্গল সূচকে দেখা যায় ৭২ শতাংশ শিক্ষক মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করেন।তাহলে এখনকার অবস্থা কেমন? এত মানসিক চাপ নিয়ে অ্যাসাইনমেন্টের মূল্যায়ন কতটুকু করতে পারবেন বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। সেদিন এক ভদ্রলোকের(স্কুলের অভিভাবক) সাথে রাস্তায় দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পর বললেন স্যার আপনাদের জন্য বড্ড মায়া লাগে। এতো দীর্ঘ সময় আপনারা সম্মানি থেকে বঞ্চিত। কীভাবে দিনাতিপাত করেন।

অন্য সব সেক্টর খোলা শুধু আপনাদের বন্ধ। তারপর বললেন স্যার আমার জায়গাতে থাকলে আপনি কি এতো মাস পড়ালেখা ছাড়া বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতেন? ভাবনায় পড়ে গেলাম ভদ্রলোক কি ভালোবাসা প্রকাশ করলেন নাকি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করলেন। ভাবনার জগতে হারিয়ে গেলাম। হাজার বছর ধরে উপন্যাসে “পরীর দীঘি ” র পাড়ে ও মহামারী এসেছিল। কলেরার দুর্দিন কেটে সেখানেও সুন্দর ভোর হয়েছে। গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষগুলো সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে মহামারী জয় করেছে। এভাবেই ভাবনায় হারিয়ে যান হাজারো আইউব স্যারেরা।আবার চেতনায় ফিরে আসে। একুশ শতকের এই পৃথিবী ও করোনা মুক্ত হবে— ইনশাআল্লাহ।

হয়তো প্রতিষেধক আবিষ্কার হবে নতুবা ওলা বিবি,বসন্ত বিবি ও যক্ষা বিবিদের মতো করোনা বিবি ও চলে যাবে অনেক দূরে। সে সময়ের অপেক্ষা। ।সে পর্যন্ত বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বোবা কান্না হয়তো চলবে। তাদের শব্দ করে কাঁদতে নেই। কারন তারা জাতির মেরুদন্ড গড়ার কারিগর।

লেখক: এমবিএ শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়