মধ্যবিত্ত শ্রেণির তথ্যভিত্তিক কিছু কথা

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৪:২৯ অপরাহ্ণ, জুন ১৬, ২০২১

মারজান আক্তার: ‘অর্থ’ ছাড়া জীবন অচল, মূল্যহীন, কোন দাম নেই, মৃতের সমান ইত্যাদি ইত্যাদি। কেননা বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বে মানবজীবনের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ‘অর্থ’। অর্থ ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভবপর নয় বলে প্রবাদে আছে ‘জীবন মানে অর্থ’। অর্থ্যাৎ হায়াত থাকলে অর্থ ছাড়া মানবজীবনের এক কদম পাও চলা সম্ভবপর নয় তবে তা হতে পারে কম বা বেশি কিন্তু লাগবেই ‘ফরজ’। বাংলাদেশের চলমান সমাজব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখে যায় এখানে অর্থনৈতিক দিক থেকে তিনটি শ্রেণি বিরাজমান রয়েছে নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ বিত্ত। এই তিনটি শ্রেণিকে আবার তিনটা করে উপশ্রেণিতে বিভক্ত করা যায় যথা- নিন্ম মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এভাবে সবগুলোকে।

বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপত্তি পাঠান যুগ হতে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরা মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্থান দখল করে নেয়। তারপর পাকিস্তান শাসনামলে বাংলাদেশে একটা শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠে। যারা সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক সম্পর্কগুলো সহ অনেকগুলো ক্ষেত্র ছিল বেশ রক্ষণশীল। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তির পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাথে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোন আপোষ হয়নি বলে ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সকল আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছিল বিরাট ভূমিকা। যদিও স্বাধীনতার পর এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি উচ্চ শ্রেণিতে নিজেদের স্থান করে নেয়।

আমার মতে, “মধ্যবিত্ত শ্রেণী হলো এমন একটা শ্রেণির মানুষ যাদের অবস্থান নিন্মবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মাঝখানে, যারা কখনও অধিক কখনও স্বল্প পরিশ্রম করে এবং যন্ত্র যুগের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে এমন একটা অবস্থান তৈরি করে যেখানে তাদেরকে কখনও মজুর আবার কখনও পুঁজিপতি মনে হয়”।

ড. বিনায়ক সেন ২০২০ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হলো তাঁরা যারা দারিদ্র্য রেখার উপর আছে, যাদের আয় ৪০-৮০ হাজার টাকার মধ্যে (১২ই এপ্রিল ২০২১. প্রথম আলো)। কোভিট-১৯ পরিস্থিতির আগে এই হার ৩০% হয়েছিল বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

২০১৫ সালে ড. বিনায়ক সেন বাংলাদেশের মধ্য বিত্ত শ্রেণি নিয়ে গবেষণা করেন। এই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশে ২০% লোক মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতায় রয়েছে। সেই সাথে তিনি এটাও বলেছিলেন এই হার ২০৩০ এ হবে ৩৩% এবং ২০৩৩ সাল নাগাদ হবে এক তৃতীয়াংশ। তবে চলমান কোভিট-১৯ পরিস্থিতি এই হারের গতিকে মন্থর করে দিয়েছে, দিচ্ছে। কেননা এই পরিস্থিতিতে মানুষ এর সংক্রমণ হতে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিজেদেরকে আগের মত সংযুক্ত করতে পারেনি বিধায় নতুন করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হওয়া তো দূরের কথা বরং অনেক পরিবার মধ্যবিত্ত শ্রেণির হতে নিন্মবিত্ততে নেমে এসেছে।

মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমন একটা শ্রেণী যারা একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। উদাহরণ হিসাবে চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলা যেতে পারে। এই দুই দেশের আজকের সফলতার পেছনে রয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিরাট ভূমিকা। গবেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, উদ্যোক্ততা, প্রবৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীন বাজার বৃদ্ধি দাতা, ভালো শাসন প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রাখা, সরকারি কাজ ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বেশি স্বচ্ছতা- জবাবদিহিতা দাবি করতে পারা, মূল্যবোধ মানব পুঁজি আহরন ও সঞ্চয়ের উপর অধিক গুরুত্ব দেয়া।

আমার মতে সত্যিকারের মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপরের বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি আরো কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে- এই শ্রেণির মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাস প্রবল থাকে বলে এর ধর্ম মেনে চলে বেশি, ন্যয়-অন্যায় বোধ থাকে সদাজাগ্রত, শিক্ষায় আগ্রহ থাকে ব্যাপক, কুসংস্কার মুক্ত থাকে, পাছে লোকে কিছু বলার ভয় থাকে বেশি, বিবেকবোধ ও আত্মসম্মান বোধ থাকে তীব্রতর, মানবিকতা-মানবতাবোধ থাকে সদা জাগ্রত, সহজে মানুষকে বিশ্বাস করে, সহজে কাউকে আঘাত করে না আবার অন্যায়ের সাথেও খুব সহজে আপোষ করে না, না খেয়ে উপোস থাকলেও কারোর কাছে হাত পাতে না, সহজ-সরল জীবন যাপন করতে পছন্দ করে ইত্যাদি।

তবে বর্তমান সময়ে এরকম মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা অনেক কম। তাছাড়া বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক,রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কারনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ‘কোণঠাসা’ হয়ে গেছে অথচ একটা দেশের সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়নে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই রেখে থাকে বিরাট ভূমিকা। কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার কারনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের আত্নসম্মানবোধ টিকিয়ে রাখতে সামাজিক, রাজনৈতিক সহ অনেক ইস্যুতে(যেসব জায়গায় তাদের অগ্রনি ভূমিকা রাখার কথা সেসব জায়গায়) কোন রকম কথা বলা বা ভূমিকা রাখা হতে বিরত থেকে দিনাতিপাত করে চলছে। সুদিন (নির্বিঘ্নে ভালো কথা বলার ও কাজ করার সুযোগ পাবে) এলে আবারও মধ্যবিত্ত শ্রেণি তার নিজ ভূমিকায় ফিরে যাবে বলে আমি আশাবাদী।

লেখক:

ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞানী এবং এমফিল গবেষক, নোয়াখালী