চরম হতাশায় সাড়ে ৫ হাজার অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক

Sarwar Sarwar

Miran

প্রকাশিত: ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৪, ২০২১

হারুন অর রশিদ:

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা ও দ্বৈতনীতির বেড়াজালে আটকে পড়েছেন সারাদেশের সাড়ে ৫ হাজার অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক। দীর্ঘ ২৯ বছর থেকে বেসরকারি কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু থাকলেও জনবল কাঠামোতে পদ সৃষ্টি না করার  কারণে এসব শিক্ষক এমপিওভুক্তির বাইরে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক চিঠি, ৯ম ও ১০ম সংসদের শিক্ষা সম্পর্কিত স্হায়ী কমিটির এমপিওভুক্তির সুপারিশ, দেশের সব শিক্ষক সংগঠনের এমপিওভুক্তির দাবি উত্থাপন সহ বিশিষ্ট সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের পরামর্শ আমলে নিচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমপিওভুক্তির  বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে মতামত বা সুপারিশ না করে বারবার কলেজ কর্তৃপক্ষকে চাপ দিচ্ছে। অথচ কোভিড-১৯ অতিমারির আগেও সিংহভাগ কলেজে শিক্ষকদের বেতন দেয়া হত না। উল্লেখ্য যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন প্রদানের জন্য  জুলাই/২০১৬ সাল এবং ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্দেশনামূলক চিঠি প্রেরন করলেও,  কলেজগুলো তা কখনোই আমলে নেয়নি। বর্তমানে কোভিডের তান্ডবে যখন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি নির্দেশে বন্ধ রয়েছে ঠিক সেই মূহুর্তে গত ১৩ জুন/’২১ তারিখ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবারও  শিক্ষকদের বেতনের বিষয়ে কলেজ গভর্নিং বডিকে নির্দেশনা প্রদান করে এবং নির্দেশনা না মানলে অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তে যাওয়ার প্রক্রিয়ার কথা জানানো হয়। এই নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ তা বোধগম্য নয়। যখনই শিক্ষকরা এমপিওভুক্তির দাবিটি নিয়ে সোচ্চার হন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখনই নড়েচড়ে উঠে এরকম চিঠি ইস্যু করে। এবার অধিভুক্তি বাতিলের কথা বলাতে পরোক্ষভাবে শিক্ষকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ  যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।

কলেজ গভর্নিং বডির অঙ্গীকারনামায় শিক্ষকদের হাত ছিল না,তাই আমরা কলেজ থেকে বেতন চাইনা,সরকারিভাবে সুযোগ-সুবিধা তথা এমপিওভুক্ত হতে চাই। দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এমপিও না নেয়ার শর্তে গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে এমপিওভুক্ত হয় এবং ডিগ্রী ৩য় শিক্ষকগণও এমপিও না হওয়ার শর্তে  নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্তির আওতায় আসলে আমাদের বেলায় ঠুঁনকো যুক্তি কেন? আমাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে এমপিওভুক্তির বিকল্প নেই। যেহেতু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গত ২৯ বছর অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সমস্যা সমাধান করতে পারেনি, সেহেতু এমপিওভুক্ত করতে হবে। এটা সর্বজনস্বীকৃত যে,এমপিওভুক্তি না থাকায় শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা গণনা করা হয়না ফলে প্রশাসনিক পদে অর্থাৎ প্রিন্সিপাল/ভাইস- প্রিন্সিপাল পদে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ থাকেনা।

এছাড়াও সহকর্মীদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়,চাকুরীর নিশ্চয়তা ও ভবিষ্যত আর্থিক নিরাপত্তা নেই।একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে অনেকেই জাতীয়করণকৃত কলেজে ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন এবং ডিগ্রি ৩য় শিক্ষকগণ এমপিওভুক্তির আওতায় এসেছেন। বেসরকারি কলেজে অনার্স কোর্স অধিভুক্তির বিষয়টি সরকারের জ্ঞাতার্থে রাখতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাউশির মহাপরিচালক মহোদয়কে অনুলিপি প্রেরণ করে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এমপিওভুক্তির দাবি জানানো হলে জনবল কাঠামো না থাকা ও কলেজ কর্তৃপক্ষের অঙ্গীকারনামার অজুহাত দেখানো  হয়। যা শিক্ষা সেক্টরে চরম বৈষম্য সৃষ্টির নামান্তর। শিক্ষামন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রশি টানাটানি ও বিধির মারপ্যাঁচে শিক্ষকরা চরম হতাশায় নিমজ্জিত।

মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রীদ্বয় ও ভিসি মহোদয়ের অস্পষ্ট বক্তব্যের কারণে সারাদেশের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এমপিওভুক্তির অনিশ্চয়তায় শিক্ষকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে বিরুপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের রোগে জর্জরিত হয়ে চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে দুইজন শিক্ষক মারা গেছেন। চাকরি হারানোর আশঙ্কায় আরও কয়েকজন শিক্ষক গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও অধিকাংশ শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে না পারায় যে  অজানা রোগ (টেনশন) এ আক্রান্ত তার একমাত্র সমাধান সরকারকে  খুঁজতে হবে। আর তা হলো এমপিওভুক্তির আওতায় নিয়ে আসা।

মাসিক মাত্র ১২ কোটি টাকা হিসেবে বছরে মোট ১৪৪ কোটি টাকা বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ হলেই শিক্ষকদের স্বপ্ন পূরণ হবে।৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটে এটা অতি নগন্য টাকা বটে।আমরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও শিক্ষা বাণিজ্যে নিয়োজিত গভর্নিং বডির ষড়যন্ত্রের শিকার। যে দেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে,সেখানে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের জন্য কেন সামান্য টাকা বিনিয়োগ করা হবেনা? বেসরকারি পর্যায়ে কতটি  কলেজে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  নজরে থাকলেও শুধুমাত্র এমপিও না দেয়ার জন্য বিধির গ্যাড়াকলে আবদ্ধ রাখা হয়েছে। এমনকি শিক্ষকদের নিয়োগ ও যোগ্যতার প্রশ্ন তুলছে,যা অত্যন্ত দু:খজনক। বারবার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা তৈরিতে অনার্স  শিক্ষকদের সাথে বিমতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে, যা মেনে নেয়া কষ্টকর। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি অনার্স-মাস্টার্স কোর্স সীমিতকরণ ও গ্রাজুয়েটদেরকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার জন্য শর্টকোর্স চালু করার কৌশল নির্ধারণে  কাজ করছেন।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর এসব সৃজনশীল চিন্তা- ভাবনাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু যে কোর্সই চালু করা হোক না কেন আগে অনার্স শিক্ষকদের দ্রত এমপিওভুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায়  আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার চিন্তা ছাড়াই শর্টকোর্স চালু করা হলে  যেই লাউ সেই কদু হবে। নারীর ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে নারী শিক্ষাকে সর্বজনীন করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি কলেজগুলোতে অনার্স কোর্স চালু করেছিল। সরকারের সুনাম অর্জনে শিক্ষকরা সহায়ক ভূমিকা রাখায় এমপিওভুক্তির যৌক্তিকতা কেউ অস্বীকার করতে পারবেনা।

এমতাবস্থায় শিক্ষাবান্ধব সরকারের কাছে আকুল আবেদন অনতিবিলম্বে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের এমপিওভূক্তির ব্যবস্থা করুন।

 

লেখক:

আহবায়ক

বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশন।